পঞ্চগড়ে ৯ মাস বয়সী শিশু নুরীকে নিয়ে চার দিনে যা হলো

৯ মাস বয়সী মেয়ে নুরীকে কোলে নিয়ে বাড়িতে হাস্যোজ্জ্বল মা শরিফা খাতুনছবি: প্রথম আলো

সড়কের পাশে একটি হলুদখেতে ছোট্ট একটি শিশুকে উপুড় করে ফেলে রেখে পালাচ্ছিলেন এক নারী। বিষয়টি দেখে স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ হলে শিশুটিকে উদ্ধারের পাশাপাশি আটকে রাখেন ওই নারীকে। তবে শিশুটি ওই নারীর নিজের সন্তান বলে জানান। এ সময় রুনা আক্তার নামে স্থানীয় এক গৃহবধূ শিশুটিসহ তার মাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে রুনা আক্তারকে নিজের ৯ মাস বয়সী শিশুটিকে লালনপালনের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান ওই নারী।

গত মঙ্গলবার পঞ্চগড় পৌরসভার দক্ষিণ তেলীপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রেখে যাওয়া শিশুটির নাম নুরী। শিশুটিকে রেখে যাওয়া ওই নারীর নাম শরিফা খাতুন (৩৪)। তিনি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি ইউনিয়নের জেমজুট কারখানা সংলগ্ন মুসলিমবাগ এলাকায় মায়ের সঙ্গে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

শরিফা খাতুনের প্রথম স্বামীর ঘরের একটি ১৪ বছর বয়সী ছেলে আছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের ৭ বছর ও ৯ মাস বয়সী দুটি মেয়ে আছে। জেমজুট কারখানার শ্রমিক মায়ের সঙ্গে থাকেলেও স্বামী (নুর ইসলাম) অন্যত্র থাকায় ভিক্ষাবৃত্তি করে তিন সন্তানকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন শরিফা।

শনিবার সন্ধ্যায় পঞ্চগড় পৌরসভার দক্ষিণ তেলিপাড়া ও বোদা উপজেলার মুসলিমবাগ এলাকায় স্থানীয় লোকজন এবং পরিবার দুটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার শিশুটিকে ফেলে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজনের কাছে আটক হয়ে শিশুটির ভরণ-পোষণ দিতে পারছেন না বলে জানান শরিফা। তাঁর এমন কষ্টের কথা শুনে শিশুটিকে নিতে রাজি হন রুনা আক্তার। পরে সবার উপস্থিতিতে রুনা আক্তারকে স্ট্যাম্পে লিখিতভাবে শিশুটিকে দিয়ে চলে যান শরিফা খাতুন। এ সময় তাঁরা খাওয়ার জন্য শরিফাকে ৬০০ টাকা দেন। তবে শিশুটিকে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলোমেলো হয়ে যান শরিফা। নির্ঘুম রাত কাটানোর পাশাপাশি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে ঘুরতে শুরু করেন পাগলের মতো। পরে পরিবারের লোকজন শিশুটির সন্ধান পেয়ে ফেরত নিতে এলে শিশুটিকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায় রুনা আক্তারের পরিবার। পরে গত শুক্রবার বিকেলে পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) হস্তক্ষেপে শিশু নুরী তার মায়ের কাছে ফেরে।

শিশুটিকে দত্তক নেওয়া রুনা আক্তার বলেন, ‘গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বাড়ি থেকে কিছু দূরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আমিও এগিয়ে যাই। পরে সেখানে দেখি মাথার চুল এলোমেলো এক মহিলাকে কিছু লোক তাড়া করে ধরে রেখেছে। সেখানে হলুদখেতে দেখি একটা সুন্দর মেয়েশিশু। পরে শুনি ওই মহিলা শিশুটিকে ফেলে রেখে পালাচ্ছিল। পরে আমি শিশুটি ও তার মাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে আমি শিশুটিকে নিতে চাইলে ওই মহিলা রাজি হয়ে যায়। পরে স্থানীয়দের পরামর্শে লিখিতভাবে শিশুটিকে নিয়ে লালনপালন শুরু করি। শিশুটিকে নেওয়ার সময় ওই মহিলাকে খাওয়ার জন্য আমরা ৬০০ টাকা দিয়েছি। পরে গাড়ি ভাড়ার দেওয়ার জন্য আরও ৫০ টাকা দিয়েছি। শিশুটিকে নিতে আমরা কোনো জোর করিনি। সে নিজের ইচ্ছায় দিয়েছে। কিন্তু শুক্রবার পুলিশসহ প্রশাসনের লোকজন নিয়ে এসে তাঁর পরিবারের লোকজন শিশুটিকে নিয়ে গেছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ তেলিপাড়া এলাকার এক নারী জানান, হলুদখেত থেকে রুনা আক্তারের বাড়িতে আনার পর বেলা তিনটা পর্যন্ত ওই শিশু তার মা শরিফার কাছেই ছিল। কিন্তু শিশুটির মা বারবার বলছিলেন তিনি শিশুটিকে নেবেন না। এমনকি বাচ্চাটাকে একবার কোলেও নিচ্ছিলেন না।

শনিবার সন্ধ্যায় শরিফা খাতুনের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শিশু নুরীকে কোলে নিয়ে ঘরের দরজায় বসে আছেন শরিফা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমি তো ভিক্ষা করে খাই। বাচ্চাটাকে নিয়ে ভিক্ষা করতে পারি না। এ জন্য পুষানি (দত্তক) দিছিলাম। পরে ওরা আমাকে কিছু টাকা খাইতে দিছে। আর বলছে, যদি কখনো প্রয়োজন হয় তাহলে আসিও, বাচ্চাটাকেও দেখতে আসিও। পরে বাড়িতে আসার পর আমার মাথা ঠিক ছিল না। কালকে (শুক্রবার) যখন বাচ্চাটাকে আনতে যাই তখন ওই মহিলা (রুনা আক্তার) কান্না করছিল। আমার বাচ্চা আর কাউকে দেব না। আমার তিনটা বাচ্চা। এখন বাচ্চাগুলোকে যে খাওয়াব, সেই খাবারও ঘরে নাই।’

পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসেন ‍মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে পুলিশের সহায়তায় শুক্রবার শিশুটিকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি। তাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদের সহায়তার কথা বলা হয়েছে।’