যাঁর হাতে ১০ বছরে স্বাভাবিক প্রসব ২২০০ নবজাতকের
২০১৪ সালের জুলাই মাসের কথা। মরিয়ম নামের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে মুমূর্ষু অবস্থায় আনা হয় চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে। সেখানে ছিল না স্বাভাবিক প্রসবের প্রয়োজনীয় উপকরণ। শুধু প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্বাভাবিক প্রসব করান পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা আফরিন আরা। নবজাতকের মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করেন। ১২ ঘণ্টা পর মা ও নবজাতককে সুস্থ অবস্থায় বাড়িতে পাঠান।
এ ঘটনা মানুষের মুখে মুখে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রমুখী হন। তাঁদের আস্থা ও ভরসা বাড়তে থাকে। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রটিতে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল আফরিন আরা যোগ দেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে জুলাই মাসে সপরিবার ওঠেন কেন্দ্রের কোয়ার্টারে। সেই থেকে সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টার সেবা শুরু করেন তিনি। আন্তরিক চেষ্টা ও কর্মগুণে অল্প দিনেই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রিয়জনে পরিণত হন আফরিন।
আফরিন অবশ্য একা এই কৃতিত্ব নিতে চান না। কেন্দ্রের উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন, আয়া রওশন আরা ও অফিস সহায়ক আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে তাঁদের যে দল, কৃতিত্ব দিলেন তাঁদের সবাইকে। তাঁর ভাষায়, সবাই মিলে নিরাপদ সন্তান প্রসবের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। গত ১০ বছরে তাঁর হাতে ২ হাজার ২০০ নবজাতকের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। একটিও মাতৃমৃত্যুর ঘটনা নেই।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে আফরিন কতটা আন্তরিক, একটা ঘটনা থেকে তা স্পষ্ট হয়। ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল রাতে আলমডাঙ্গার খুদিয়াখালীতে অসুস্থ বাবার পাশে ছিলেন আফরিন। তখন খবর পান, অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে নিয়ে স্বজনেরা কেন্দ্রে অপেক্ষা করছেন। তখনই তিনি কর্মস্থলে ফেরেন। সুস্থভাবে প্রসব হয়, পৃথিবীর আলো দেখে নতুন প্রাণ। পরিবারের সবাই আনন্দিত। এই সময় মুঠোফোনে আফরিন খবর পান, তাঁর বাবা মারা গেছেন।
২০২২ সালের রোজার ঈদের কথা। সকালে ছেলে তাসনিম মাহমুদকে নিয়ে ঈদগাহে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আফরিনের স্বামী আবু সায়েম। আর আফরিন রান্না করছিলেন। এমন সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে নিয়ে হাজির হন তাঁর স্বজনেরা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে প্রসব করান। আরেক অন্তঃসত্ত্বা আসেন। তাঁরও প্রসব করান। বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাঁর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। আফরিনের ভাষ্য, মানবসেবার মধ্যে ঈদের আনন্দ খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি। স্বাস্থ্যসেবায় অবদানের জন্য তিনি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছেন।
৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী অন্তত ৩০ জন নারী বেঞ্চে বসে আছেন। আফরিন আরা স্বাস্থ্যসচেতনতা বিষয়ে তথ্য তুলে ধরে নির্দেশনা দেন। এরপর অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি মায়েদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও করণীয় সম্পর্ক বলেন। আলাপকালে আফরিনের সহকর্মীরা বলেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে এক ঘণ্টার কম সময়ে তিনজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করান আফরিন। ওই দিন রাতে আরও দুই নারীর সন্তান প্রসব করান তিনি। সেদিন রাতভর কাজ করার পর সকালে তিনি আবার স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করেন।
কেন্দ্রের উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, করোনার সময়ে ঝুঁকি থাকলেও আস্থার জায়গা ভেবে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা এসেছেন এবং হাসিমুখে সেবা নিয়ে ফিরে গেছেন। আফরিন যোগদানের পর থেকে ঐচ্ছিক ছুটি নেননি। অর্জিত ছুটিও ভোগ করেননি। কখনো কোনো রোগী এসে যদি ফিরে যান, সে কথা মাথায় রেখে সারা বছর ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন আফরিন।
আফরিন কাজ করে খুশি। তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক প্রসবের পর সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে বুকে নিয়ে একজন মা যখন হেঁটে গাড়িতে গিয়ে ওঠে, সেটা খুবই আনন্দের। নবজাতককে তুলে দেওয়ার সময় প্রসূতি মায়ের মুখের যে অকৃত্রিম হাসি, সেটা আমার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। আমাকে সাহসী ও কর্মোদ্যমী করে তোলে।’