সাবেক এমপি বাহার ২২ বছর মার্কেট দখলে রেখে অর্থ লুট করেছেন

কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেট। যা ‘বাহার মার্কেট’ নামে পরিচিত। বৃহস্পতিবার কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকায়ছবি: এম সাদেক

স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। এটি কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। কুমিল্লাবাসীর নানা কর্মযজ্ঞ, আন্দোলন, সংগ্রাম ও গৌরবের কেন্দ্রবিন্দু এই টাউন হল। ১৮৮৫ সালে নগরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে প্রতিষ্ঠিত টাউন হলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয় কুমিল্লার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর্থসামাজিক ও কল্যাণমুখী নানা কাজ।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে এই টাউন হল কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার। অনেকটা ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতোই টাউন হল ব্যবহার করেছেন। আর টাউন হলের পাশে অবৈধভাবে ২২ বছর মার্কেট দখলে রেখে অর্থ লুট করেছেন তিনি।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাহারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে থাকে টাউন হল। অবশেষে ২০ নভেম্বর রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে কুমিল্লা টাউন হল বাহারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। এদিন টাউন হলের সদস্যদের নিয়ে অতিরিক্ত সাধারণ সভা শেষে টাউন হলের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়ছার কমিটি বিলুপ্তের পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। সভায় বাহারের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে তাঁর বিচার দাবি করা হয়েছে। কমিটি বিলুপ্তের পাশাপাশি সভার মূল আলোচনার বিষয় ছিল টাউন হল মাঠের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে অবস্থিত ‘কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেট’ নিয়ে। যা ‘বাহার মার্কেট’ নামে পরিচিত।

টাউন হল মিলনায়তনে বুধবার সন্ধ্যার দিকে শুরু হওয়া ওই সভা চলে রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত। সভা শেষে জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়ছার বলেন, দীর্ঘদিন পর কুমিল্লা টাউন হলের প্রাণ ফিরে এসেছে। কার্যকারিতা না থাকায় বর্তমান ১৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো। নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পাশাপাশি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সদস্য তালিকা নতুন করে তৈরি ও নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তি এবং গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য উপকমিটি করা হবে। পুরোনো স্থাপত্যশৈলী ঠিক রেখে টাউন হলকে প্রতিষ্ঠার সময়ের অবস্থায় নিয়ে সাজানোর জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ জন্য জেলা পরিষদ থেকে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ১৯৯২ সালের ৯ জুন একটি ইজারা চুক্তি দলিল মূলে আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ার টাউন হল সুপার মার্কেটের মালিক হয় ১০ বছরের জন্য। ইজারার শর্ত ছিল, ঠিকাদার হিসেবে তিনি নিজের টাকায় ভবন তৈরি করবেন এবং ১০ বছরের ভাড়া নেবেন। ভাড়া থেকে কিছু অংশ টাউন হলকে দেবেন। ১০ বছর পূর্ণ হলেই এই চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে এবং মার্কেটের মালিক হবে টাউন হল। সে হিসাবে ২০০২ সালে ইজারা চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। এরপর গত ২২ বছর নোটারি পাবলিক করা ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে অবৈধভাবে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে আইনগতভাবে এর কোনো ভিত্তি ছিল না। মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমুদয় অর্থ টাউন হলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেবেন। এখন থেকে ওই মার্কেটের মালিক টাউন হল।

কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় বাসিন্দা ও টাউন হল সূত্রে জানা যায়, বাহার মার্কেটের নিচতলায় প্রায় ১০০টি দোকান আছে। নির্মাণের পরই এসব দোকানের পজেশন বিক্রি করে দেন বাহার। বর্তমানে প্রতিটি দোকান থেকে ভাড়া হিসেবে এক হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। দ্বিতীয় তলায় আছে ৪২টি বড় দোকান। এগুলো একইভাবে পজেশন বিক্রি করে প্রতি মাসে একটি শাটারের জন্য ১ হাজার ৬০০ এবং দুটি শাটারের জন্য ৩ হাজার ২০০ টাকা করে ভাড়া আদায় করতেন বাহার। আর তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আছে বাহারের মেয়ে আয়মান বাহার সোনালীর নামে ‘আবাসিক হোটেল সোনালী’। সেখানে ২৮টি কক্ষ থেকে প্রতিদিন অন্তত ৪০ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে ১২ লাখ টাকা আয় হতো বাহারের। মার্কেট থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা লুটে নিলেও টাউন হলের অ্যাকাউন্টে বাহার মাসে মাত্র ২২ হাজার ৫০০ টাকা জমা দিতেন। তাঁর লুটপাটের কারণে ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠান টাউন হল জরাজীর্ণ হয়ে এখন ধুঁকছে।

মার্কেটটির অন্তত পাঁচজন ব্যবসায়ী জানান, ২০ শতক ভূমির ওপর নির্মিত ‘বাহার মার্কেট’ থেকে বাহারের প্রতি মাসে আয় হতো ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা। নিচতলার দোকানগুলোর পজেশন শুরুর দিকেই বিক্রি করেছেন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে। আর দ্বিতীয় তলার দোকানগুলো ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন।
অতিরিক্ত সাধারণ সভায় টাউন হলের সদস্যদের মধ্যে অন্তত ১৩ জন বক্তব্য দেন।

তাঁরা বলেছেন, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কখনো এভাবে সাধারণ সভা হতে দেননি বাহার। সব সময় তিনি নিজের লোক দিয়ে পকেট কমিটি করেছেন এবং নতুন কাউকে সদস্য হতে দেননি। বাহার চেয়েছিলেন টাউন হলের ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ভেঙে আধুনিক কমপ্লেক্স করতে। টাউন হলকে কুক্ষিগত করে বাহার কত টাকা লুটেছেন, এ জন্য তদন্ত কমিটি করার দাবি জানিয়েছেন বক্তারা। আবার কেউ কেউ বাহারকে ‘দানব’ আখ্যা দিয়ে বাহার মার্কেটকে টাউন হলের কলঙ্ক বলে মন্তব্য করেছেন। অনেকে মার্কেটটি ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছেন।

কুমিল্লা টাউন হলের সদস্যদের নিয়ে অতিরিক্ত সাধারণ সভা করা হয়েছে। ২০ নভেম্বর রাতে।
ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, একসময় কুমিল্লার গণমানুষের জ্ঞান অন্বেষণের জন্য পাঠাগার ছিল না। ১৮৮৫ সালের আগে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তৎকালীন শিক্ষানুরাগী বেশ কয়েকজন ব্যক্তি পাঠাগার করার জন্য উদ্যোগী হয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এফ এইচ স্ক্রাইনের শরণাপন্ন হন। পরে জেলা প্রশাসক ওই দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে পাঠাগারের জন্য তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার চাকলা রোশনাবাদের জমিদার নরেশ মহারাজ ‘বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর’–এর কাছে জমি চান। জমিদার ওই সময়ই কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমি বরাদ্দ দেন এবং একটি ভবন নিজস্ব অর্থায়নে করে দেন। ১৮৮৫ সালের ৬ মে প্রথমে গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা হয়। এর পরেই সাংস্কৃতিক চর্চাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে নগর মিলনায়তন বা কুমিল্লা টাউন হল ভবনটি নির্মিত হয়।