প্রথম আলোর অনুসন্ধান
তাপ নোনা খরায় পরাস্ত সন্দ্বীপের কৃষক
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত অবারিত সবুজ, সবজি আর রবিশস্যের শ্যামলিমা। তারপর একটুখানি সাগর পাড়ি দিলেই সন্দ্বীপ। এবার কিন্তু অবাক হওয়ার পালা। উর্বর পলিমাটির এই ভূখণ্ডে সবুজ উধাও, ফসলের মাঠ শূন্য, বিরান। এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। এ নিয়েই প্রথম আলোর অনুসন্ধান।
সন্দ্বীপের প্রসিদ্ধ মিষ্টি আলুর কথা ১৯৭৪ সালে তখনকার সংসদ সদস্য এম ওবায়দুল হকের মাধ্যমে পৌঁছেছিল জাতীয় সংসদ পর্যন্ত। দেশে খাদ্য মজুত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে ওবায়দুল হক (প্রয়াত) বলেছিলেন, ‘আমার সন্দ্বীপে মাটির নিচেই জমা আছে ছয় মাসের খাদ্য।’ সন্দ্বীপের বয়স্ক কৃষকেরা জানিয়েছেন, ওই ঘটনার পর কীভাবে যেন ওবায়দুল হকের নাম হয়ে যায় ‘আলুমন্ত্রী’। সংসদে দেওয়া তাঁর ওই তথ্যও ছিল সঠিক। তখন সন্দ্বীপে গ্রামের পর গ্রামজুড়ে কৃষকের জমিতে মিষ্টি আলুর চাষ হতো।
দুই দশক আগেও দুপুরের রান্না শেষে মাটির চুলার জ্বলন্ত কয়লায় পোড়ানো মিষ্টি আলুর মোহনীয় ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত ঘরে ঘরে। সেই সন্দ্বীপে এখন মিষ্টি আলুর দেখা তো নেই-ই; শ্রাবণ থেকে কার্তিক পর্যন্ত বড়জোর চার মাস রাজাশাইল আমন ধান ছাড়া বছরের বাকি আট মাস খাঁ খাঁ করে সন্দ্বীপের মাঠ–খেত। কোথাও কোনো ফসলের চিহ্ন নেই। উর্বর পলিমাটির এই দ্বীপ থেকে উধাও হয়ে গেছে ডাল, তিল, তিশি, মরিচ, আলু, তরমুজ, বাঙ্গি, শীতের সবজির মতো ফসলও। রবিশস্য বলে তেমন কিছুই নেই এখানে।
এবার অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে রাজাশাইল ধান। সেখানে রবি মৌসুমে শাকসবজির চাষ হতে পারে মাত্র ৩ হাজার ৪০০ হেক্টরে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার এই তথ্যেই প্রমাণ মেলে, সন্দ্বীপের অন্তত ৯৭ শতাংশ কৃষিজমিই রবি মৌসুমে পতিত পড়ে থাকছে।
এককালের কৃষিসমৃদ্ধ সন্দ্বীপের এই হাল কেমন করে হলো? প্রথম আলোর অনুসন্ধানে চিহ্নিত হয়েছে অন্তত সাতটি প্রধান কারণ। ১. তীব্র তাপদাহে কৃষকদের মাঠে টিকতে না পারা; ২. মাটি-পানির লবণাক্ততা বেড়ে ফলন নষ্ট হওয়া; ৩. সেচের জন্য মিঠাপানির হাহাকার; ৪. অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি বা অসময়ে বৃষ্টি; ৫. দীর্ঘস্থায়ী খরা; ৬. ঘন ঘন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং ৭. নতুন নতুন রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উৎপাত।
কারণগুলোর প্রতিটিই যে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষজ্ঞরাও সে রকম মত দিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই সাত অভিঘাত দেখতে দেখতেই পাল্টে গেছে সন্দ্বীপের দৃশ্যপট। মাঠের পর মাঠ কৃষিজমি পড়ে থাকে বিরান, পতিত। আর কৃষকের অলস সময় কাটছে বাড়ির আঙিনায়; চায়ের দোকানে। কেউ পেটের দায়ে অটোরিকশা চালান; ট্রাকচালকের সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেন; নৌকায় যান মাছ ধরতে; কেউ হন দেশান্তরি। অনেক কৃষককে দেখা যায় নিজের ১০-২০ বিঘা জমি পতিত ফেলে রেখে অন্যের ধানখেতে দিনমিজুরি করছেন।
এই অনুসন্ধানে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে কৃষককে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো কীভাবে কাজ করছে এবং তা কৃষকের ঠিক কতটা কাজে আসছে, সেটাও জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো।
নির্ভুল তথ্যের জন্য সমীক্ষা
প্রায় ছয় মাস ধরে মাঠে মাঠে কৃষকের জবানিতে পাওয়া অন্তহীন সমস্যা লিপিবদ্ধ করা হয়। পরে সেগুলো আরও নির্ভুলভাবে জানতে-বুঝতে একটি জরিপ-সমীক্ষা চালানো হয়। সন্দ্বীপের বেশি আবাদি জমি যেখানে, সেই পূর্ব উপকূলের চারটিসহ মোট ছয়টি ইউনিয়নের ১৮টি ওয়ার্ডেই মাঠে কর্মরত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। ২২ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ওই সব ওয়ার্ডের ২৩ থেকে ৯০ বছর বয়সী ২০০ জন কৃষকের কাছে গিয়ে লিখিত প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ওয়ার্ডগুলোয় কৃষকের সংখ্যা সরকারি দপ্তরে না পেয়ে সরেজমিনে অনুমানিক ৩ হাজার বলে জানা যায়। সেই হিসাবে প্রথম আলোর সমীক্ষা অন্তত ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ কৃষকের ওপর পরিচালিত হয়েছে।
সুনির্দিষ্ট ও উন্মুক্ত—দুই ধরনের প্রশ্নের আলোকেই সমীক্ষা জরিপটি চালানো হয়। ১৭টি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রের ফরম তৈরি করে কৃষকদের দোরগোড়ায় গিয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনে ফরম পূরণ করে সবার স্বাক্ষর বা টিপসই নেওয়া হয়। পরিসংখ্যানের পাশাপাশি প্রশ্নের বিষয়গুলো নিয়ে কৃষকদের ভাবনা-অনুভূতিও সংগ্রহ করা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে থাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
চাষাবাদ দিন দিন কঠিন হচ্ছে কি না, জানতে চাওয়া হয়েছিল একটি প্রশ্নে। শতভাগ কৃষকেরই দ্বিধাহীন উত্তর—কঠিনই শুধু না, চাষাবাদ দিনে দিনে দুঃসহ্য কঠিন হয়ে উঠছে।
‘লাঙলের বদলে ট্রাক্টর, কাঁচির বদলে হারভেস্টার হাতের নাগালে এসেছে। এই সময় চাষাবাদ সহজ না হয়ে কেন কঠিন হচ্ছে’—এটা বোঝার জন্য তিনটি প্রশ্ন ছিল। ১০০ ভাগ কৃষক অভিন্ন উত্তর দিয়ে তা স্পষ্ট করেছেন। খরা, নোনা ও অকালবর্ষণকে তাঁরা কৃষির শক্তিশালী শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সমীক্ষার ফলাফল বলছে, চাষাবাদে নির্ভর করে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে কৃষকের। চাষাবাদে নেমে উল্টো লোকসানে পড়ার কথাও জানিয়েছেন অনেকে। খরা, লবণাক্ততা আর দুর্যোগে ফসল হারানো, খরচ বেড়ে যাওয়া এবং উৎপাদন কমে যাওয়ার মতো বিপত্তির মুখে পড়েই ফসলের মাঠের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে কৃষকের। গত দুই যুগে ধীরে ধীরে মাঠের সঙ্গে তৈরি হয়েছে কৃষকের দিশাহীন দ্বন্দ্ব।
কেন পতিত ৯৩ শতাংশ কৃষিজমি
বর্ষায় লবণসহিষ্ণু আমনের জাত ‘রাজাশাইল’ চাষের মৌসুমে সন্দ্বীপের কোনো জমিই পতিত থাকছে না। স্থানীয় কৃষক ও বয়স্ক ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দুই যুগ আগেও বেশির ভাগ জমিতে রবিশস্যের ভরপুর চাষাবাদ হতো। প্রথম আলোর সমীক্ষা বলছে, আবহাওয়ার ধরন বদলে যাওয়ায় তৈরি হওয়া চরম পরিস্থিতিতে চাষে খরচ বেড়েছে। ফসল টিকিয়ে রাখতে কঠিন সংগ্রাম করছেন কৃষকেরা।
সরকারি হিসাবে সন্দ্বীপে কৃষিজীবী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। দেখা গেছে, এদের ৯০ শতাংশই ‘এক ফসলের’ (রাজাশাইল) কৃষক। শতবর্ষী এই রাজাশাইলের চাষ থেকে কৃষকের পিছপা না হওয়ার পেছনে রয়েছে এই ধানের অসীম সহ্যশক্তি। লবণজোয়ার, অতিবৃষ্টি, ঝোড়ো বাতাস বা ঘূর্ণিঝড়; এমনকি খরায়ও এই ধানের টিকে থাকার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। অন্য কোনো ফসলের এমন অভিযোজন ক্ষমতা নেই। ফলে রবি মৌসুমে পতিত পড়ে থাকছে মাইলের পর মাইল কৃষিজমি। মাঠে মাঠে ঘুরে দেখা গেছে, সেচের জন্য হাহাকারের চিত্র। উপকূলের এই লবণমাটিতে শস্য ফলাতে সেচের পানির জোগান জরুরি।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া কৃষকদের ৯৭ শতাংশই জানিয়েছেন, মাঠের স্বাভাবিক ‘তস’ (আর্দ্রতা) চলে যাওয়ার পর তীব্র হয়ে ওঠে লবণাক্ততা। তখন আর কোনো ফসল লাগাতে পারেন না তাঁরা। শুষ্কতা আর লবণের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত মিঠাপানির ব্যবস্থা থাকলে এক খরচের জমিতে দুই–তিন দফায় ফসল ফলাতে পারতেন কৃষক। হাতে গোনা যে কয়জন এখন শাকসবজির চাষাবাদ করছেন, তাঁদের মৌসুমের প্রথম ভাগে কোনোমতে একটি ফসল ঘরে তুলেই মাঠ থেকে উঠে আসতে হচ্ছে।
‘জলবায়ু বুঝি না, নুনা-খরান বুঝি’
কৃষকদের ১০০ ভাগের মতেই, লবণাক্ততা দ্রুত বাড়ছে। রোগবালাই আর পোকার উপদ্রব আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে বলেও মনে করেন সমীক্ষায় অংশ নেওয়া সকলে। ৭০ শতাংশ কৃষকের দাবি, খরা আর লবণাক্ততার কারণে শ্রমের মূল্য বেড়েছে। কিন্তু মানুষের কর্মক্ষমতা কমেছে। সেচের পানির সংস্থান নেই ৯৫ শতাংশ কৃষকের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে কৃষকেরা আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় খুব ভালো না বুঝলেও খরা, লবণাক্ততা, অকাল বর্ষণ আর রোগবালাইকে দুর্দশার কারণ বলেছেন।
সন্তোষপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চাষি মো. সেলিম গত বছরেই খরা আর রোগবালাইয়ের মুখে ফসল হারিয়ে তিন লাখ টাকা পুঁজি খুইয়েছেন। ১০ বছর ধরে যে সময়টিতে সেলিম দুই হাতে কাজ করেছেন মাঠে, সেই একই সময়ে এখন তিনি চায়ের দোকানে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। সেলিম প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এইবার আর চাষ করার পুঁজি নাই; অন্য কোনো কাজেরও সুযোগও নাই।’
সেলিমের জ্যাঠা আবুল হাসান (৮৫) একসময় ছিলেন দাপুটে কৃষক। চাষের একাল আর সেকালের পার্থক্য জানতে চাইলে তিনিও স্বীকার করেন, ‘চাষের আবহাওয়া আগের মতো নাই।’ গাছুয়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক আবুল কাশেম (৬০) বলেন, ‘আগে আবহাওয়ার গতিক (অবস্থা) ভালো ছিল, এখন কোনো তাল নাই। এ বছর এক রকম, পরের বছর উল্টা। কৃষকের লাই এইটা খুবই খারাপ।’ গাছুয়া ইউনিয়নের মো. বাহার (৭৫) বলেন, ‘জলবায়ু বুঝি না, নুনা আর খরান বুঝি। নুনা, খরান আর কদিন পরপর ‘নিম্মচাপ’ দেইখতে দেইখতে অতিষ্ঠ আছি।’
কৃষকদের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতাকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল বলে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘অবশ্যই কৃষকের অভিজ্ঞতায় ধরা দেওয়া এসব পরিস্থিতি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ অভিঘাত। কৃষকেরা ভুল কিছুই বলেনি। আমি ২০ বছর ধরে এই কথাগুলোই বলে যাচ্ছি। উপকূলীয় এলাকাগুলোয় ঘুরে মাঠের কৃষকের কাছ থেকেই তো তথ্য নিয়েছি। গত ২০ বছরে সারা পৃথিবীতে তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, অথচ এটা বাড়ার কথা এক শ বছরে! তাহলে বুঝতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিও দ্রুত বাড়ছে। ভবিষ্যতে এই হুমকি বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কমে আসার কোনো কারণ নেই।’
তাপমাত্রা কৃষির একটি বড় প্রভাবক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাপমাত্রা কৃষি এবং কৃষক উভয়কে প্রভাবিত করছে, ফলে মাঠে ফলন কমে যেতে পারে আবার কৃষকের কর্মশক্তিও হ্রাস পেতে পারে।’
২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ষষ্ঠ আন্তসরকার প্যানেলের মূল্যায়ন প্রতিবেদনও প্রমাণ করে, কৃষকদের মুখে বর্ণিত সমস্যাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রত্যক্ষ ফল। প্রতিবেদনে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে প্রায়ই খরা, তাপপ্রবাহ, পানির সংকট এবং বন্যার কারণে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
‘খরানের সময় ঝড়, ঝড়ের সময় খরান’
গাছুয়া হক সাহেবের বাজার থেকে পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে দুই পাশেই বিস্তৃত ফসলের মাঠ। এই অবারিত মাঠে ২০ থেকে ২৫ বছর আগেও তরমুজ, বাঙ্গি, আলুসহ নানান জাতের ডাল ও তৈলবীজের চাষ হতো। এখন সেসব জমির বেশির ভাগই থাকছে পতিত। কিছু কিছু জমি সবজি চাষের জন্য প্রস্তুত করছিলেন কৃষকেরা। সেখানে কথা হয় ১৫ থেকে ২০ জন কৃষকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ২০২১ ও ২০২২ সালের বর্ষায় বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। এত ক্ষণস্থায়ী ও স্বল্প বৃষ্টির বর্ষা ঋতু নাকি তাঁরা দেখেননি আগে। ২০২৩ সালে বৃষ্টি সামান্য বাড়লেও যথেষ্ট ছিল না। কৃষকেরা মনে করেন, ওই তিন বছরের মোট বৃষ্টিপাতের চেয়ে এবার (২০২৪) বৃষ্টি হয়েছে অনেক বেশি। ফলে গত তিন বছরের চাষ-প্রস্তুতির সঙ্গে এবারের প্রস্তুতির কোনো মিল নেই।
সন্দ্বীপ আবহাওয়া দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত জুন থেকে সেপ্টেম্বরের গড় বৃষ্টিপাত যথাক্রমে ৫২৮, ৩৯৮, ৫০২, ৪৮৯, ২২২, ৩৩৬, ৬১০ মিলিমিটার। কৃষকদের দাবি, ২০২২ সালে কোনো বর্ষাকালই ছিল না। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া সব কৃষকেরই অভিযোগ অসময়ের খরা ও বৃষ্টি নিয়ে। তাঁরা মনে করেন, ‘ঝড়ের (বৃষ্টির) সময়ে খরান (খরা) আর খরানের সময়ে ঝড়’—গত কয়েক বছরে একটি রেসালায় (রীতিতে) পরিণত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক কাওসার পারভীন মনে করেন, গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণে খুব বেশি তারতম্য না থাকলেও কৃষকের কাছে বর্ষাকাল ছোট-বড় মনে হতে পারে। পুরো বর্ষায় বৃষ্টির বণ্টনে পরিবর্তন দেখছেন তিনি। প্রথম আলোকে কাওসার পারভীন বলেন, ‘কৃষকের জন্য বর্ষাকালজুড়ে বৃষ্টির দেখা পাওয়া খুবই জরুরি, কিন্তু বর্ষার প্রথমার্ধে বৃষ্টি কমেছে আবার দ্বিতীয়ার্ধে বৃষ্টি বেশ বেড়েছে। এতে কৃষক দেখতে পেলেন, বর্ষায় তাঁর ফসল পুড়ছে আবার শরতে তাঁর শাকসবজির মাঠ ডুবে যাচ্ছে।’
বেড়েছে পোকামাকড়-রোগবালাই
কৃষকেরা জানিয়েছেন, বীজতলা আর চারাগাছে পোকার অত্যাচারে দিশাহারা তাঁরা। তাঁদের কেউ কেউ রাতের বেলায় জমিতে গিয়ে ছবি তুলে পরদিন মুঠোফোন থেকে দেখিয়েছেন সেই পোকার ছবি। সম্প্রতি নতুন ধাঁচের রোগবালাই আর কীট বেড়েছে বলে অভিযোগ টমেটো আর লাউচাষিদের। তাঁরা জানিয়েছেন, এত দিন যেসব সার-কীটনাশক ব্যবহার করে ফল পেয়েছেন, সেসবে এখন আর পোকা তাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না, সারছে না রোগবালাই।
গত মৌসুমে তিন লাখ টাকা লোকসানের মুখে পড়া সন্তোষপুরের চাষি সেলিম জানিয়েছেন, তাঁর প্রায় ১ একর জমির টমেটোগাছ ফুলে-ফলে ভরে উঠতেই দেখা দেয় এক নতুন রোগ। এক সপ্তাহের মধ্যে মরে যায় সব গাছ। একই এলাকার দিলদার জানান, এ বছর তাঁর বীজতলায় টমেটো আর কপির চারা টিকছে না। গোড়া নরম হয়ে মাটিতে লেপটে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে। গাছুয়ার জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, চারা ও বাড়ন্ত ফসলের আগাকাটা পতঙ্গের অত্যাচারে তিনি অতিষ্ঠ। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘এই পোকা হঠাৎ এমন বাড়া বাড়ছে, গাছ টিকাইতে পাইরতেছি না।’ মগধরার ৯০ বছর বয়সী কৃষক শাহ আলমসহ অনেকেই ‘আগে কখনো এমন পোকার অত্যাচারে পড়তে হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছেন।
ড. আইনুন নিশাত কৃষকদের এই দাবিকেও সঠিক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন হওয়ায় পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়াটাই স্বাভাবিক।
২০১৭ সালে লাইভ সায়েন্স সাময়িকীর ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা পোকামাকড়ের ব্যাপক সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে পারে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে পোকামাকড়ের প্রজননচক্র বৃদ্ধি এবং প্রজাতির সঠিক বণ্টনে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পতঙ্গবৈচিত্র্য লোপ পেয়ে নির্দিষ্ট কিছু পতঙ্গের উৎপাত বাড়তে পারে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ধরন দ্রুত পরিবর্তন হলে অণুজীব ও পোকামাকড়ের প্রজনন ও সংখ্যাকে প্রভাবিত করার কথাও বলা হয়েছে সেখানে।
অতিমাত্রায় পলিপ্রবাহ ও জলাবদ্ধতা
দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের সারিকাইত ইউনিয়নের চৌকাতলী মৌজার বাদামতলী মোড়ে ২৪ অক্টোবর দুপুরে দেখা মেলে বেশ কয়েকজন কৃষকের। তাঁরা মাত্র মাঠের কাজ থেকে মোড়ের দোকানে এসে বসেছেন। সেখানে রাস্তার পূর্ব পাশের বিস্তৃত জলাশয় চোখে পড়ে। সেটির বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষকেরা জানান, এখানে আগে বছরে তিন খোন্দ (দফা) ফসল হতো। এখানকার আনুমানিক ১০০ হেক্টর কৃষিজমি এখন জলাশয়ে পরিণত হয়েছে।
জলাবদ্ধতা–সংকটের কথা বলেছিলেন মগধরা, বাউরিয়া ও আমানউল্লাহর কৃষকেরাও। গত পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে নতুন এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে কৃষককে। এ বিষয়ে অনুসন্ধানে মিলেছে জোয়ারের পানিতে অতিমাত্রায় পলি বহনের ফলে উপকূলরেখার উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার তথ্য। গেল বর্ষা মৌসুমে সন্দ্বীপের চারপাশে বেড়িবাঁধের বাইরের ভূমিতে অন্তত ১ ফুট পলিস্তর জমার তথ্য দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। ফলে ভেতরের অংশে পানি জমে থাকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সন্দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশে ৩০ বছর আগে জেগে ওঠা সবুজ চরের প্রায় ৪ হাজার হেক্টর আমনের জমিরও এ রকম উচ্চতা বাড়ার কথা জানিয়েছেন সেখানকার চাষিরা।
জল, জোয়ার ও পলি বহনের এই চক্র নতুন দুর্ভোগের মুখে ফেলেছে সন্দ্বীপের কৃষি ও কৃষককে। দ্রুত পলিস্তর জমার এই প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনেও যে জলবায়ু পরিবর্তন ভূমিকা রাখছে, তার প্রমাণ মেলে জলপ্রবাহে পলি বহনের মাত্রা বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে।
২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনে ভবিষ্যতে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপে পলি জমার হার ৩৪ থেকে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে এই অববাহিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। জলবায়ুর পরিবর্তনে পলি সঞ্চালন আগামী দিনে উপকূলের কৃষকদের নিত্যনতুন ভোগান্তির পথ যে তৈরি করবে, মাঠের বাস্তব অবস্থা ও কৃষকের ভাষ্যেই তা টের পাওয়া যায়।
চাষে টিকে থাকা নিয়ে সন্দেহে কৃষক
মাঠে মাঠে কৃষকদের সঙ্গে কথা চলাকালেই দুই দফা ঝোড়ো হাওয়া ও বজ্রবৃষ্টির মুখে পড়তে দেখা গেছে চাষিদের। গত ১৯ অক্টোবর ও ১ নভেম্বর অসময়ের বজ্রবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আগাম সবজি উৎপাদনের স্বপ্ন দেখা চাষিরা। বাউরিয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক মো. আবছার (৪০) ১৯ অক্টোবর দুপুর ১২টায় সার ও কীটনাশক ছিটিয়ে প্রস্তুত করা জমিতে শাক আর ক্ষীরার বীজ বুনছিলেন। সেদিন জমিতে দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। ২০ মিনিট পরই প্রবল বজ্রবৃষ্টিতে ভেসে যায় তাঁর ৭০ শতক জমি। পরে মুঠোফোনে আবছার জানান, বৃষ্টিতে তাঁর ১৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এভাবে দুবার বা তিনবারও একই জমিতে ফসল বুনতে হচ্ছে তাঁদের। এতে খরচও বাড়ছে দ্বিগুণ বা তিন গুণ। মতামত নেওয়া কৃষকদের সবাই মনে করেন, রোদের তাপ দিন দিন বাড়তে থাকায় মাঠে টিকে থাকা কঠিন হচ্ছে। ফলে শ্রমিকের কাছ থেকেও চাহিদামতো কাজ আদায় করা যাচ্ছে না। কৃষকদের ভাষ্য, ২০ বছর আগের তুলনায় শ্রমের মূল্য তিন গুণ বাড়লেও কমেছে শ্রমঘণ্টা।
প্রথম আলোর সমীক্ষায় দেখা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিপর্যস্ত কৃষকেরা চাষাবাদে টিকে থাকা নিয়ে নিশ্চিত নন। ৪০ শতাংশ কৃষক মনে করেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে চাষাবাদ ছাড়তে হবে তাঁদের। ৪৫ শতাংশ কৃষক ‘বাঁচার তাগিদে’ লাভ-লোকসানের ধার না ধেরে চাষ করে যাবেন বলে জানালেও মাত্র ১৫ শতাংশ কৃষক জানিয়েছেন, তাঁরা চাষাবাদে টিকে থাকতে পারবেন।
চাষাবাদ ছেড়ে টেকসই কোনো কাজে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত নন কৃষকদের কেউই। ইতিপূর্বে চাষাবাদ ছেড়ে দেওয়া মানুষেরা এখন কী করছেন—এমন প্রশ্নে কৃষকেরা দিনমজুরি ও নানা ধরনের কাজকর্মের কথা বলেছেন। অবৈধ মাটি পরিবহনের ট্রাক, ইলিশ মৌসুমে নৌকায় ওঠা, অটোরিকশা চালানোর মতো পেশায় যুক্ত হচ্ছে মাঠের যুদ্ধে পরাজিত কৃষক। তাঁদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, সুযোগ পেলে বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অত টাকা তাঁদের কাছে নেই।
সন্দ্বীপের বহু মানুষ উত্তর আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন। এর প্রভাব কৃষির ওপর ঠিক কতটা পড়ছে, জানতে চাওয়া হয় স্থানীয় মধ্য সন্তোষপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর কায়সারের কাছে। তিনি বলেন, ‘যাঁরা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের পরিবারের ক্রয়সক্ষমতা বাড়িয়ে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের বেশি মূল্য পেতে সাহায্য করছেন।’ আগে যেখানে মাঠজুড়ে চাষ হতো, এখন সেখানে কেন কৃষক চাষ করতে পারছেন না—এই অনুসন্ধান সরকারি বিভাগগুলোর করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষক।