ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
পুলিশের নজরদারি কম, ৩ চাকার যানবাহনের দাপট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা জেলার অংশে পড়েছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার।
দুুমুখী লেনেই উল্টো পথে চলছে তিন চাকার যান। কেউ বাধা দিচ্ছে না।
হাইওয়ে পুলিশের কোনো সদস্যকেও দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি।
মহাসড়কে তিন চাকার যান নিষিদ্ধের বিষয়টি কেবল কাগজে–কলমেই সীমাবদ্ধ।
দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাগজে-কলমে তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ; কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। দেশের অন্যতম প্রধান এই মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে তিন চাকার যান দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এতে সমস্যায় পড়ছেন বাস, ট্রাকসহ বড় যানবাহনের চালকেরা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। তিন চাকার যানের কারণেই সম্প্রতি মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে কয়েকটি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা জেলার অংশে পড়েছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। গতকাল সোমবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মহাসড়কের কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সেনানিবাস এলাকা থেকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিওড়া রাস্তার মাথা পর্যন্ত প্রায় ৪৮ কিলোমিটার ঘুরে দেখা যায়, অবাধে চলছে সিএনজিচালিত ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, পা–চালিত রিকশা ও ভ্যান। আবার কোথাও কোথাও প্রকাশ্যেই চলছে নছিমন ও ভটভটি। জমিচাষের ট্রাক্টরের পেছনে ট্রলি লাগিয়ে মহাসড়ক দাবড়ে বেড়াতে দেখা গেছে।
মহাসড়কটির কুমিল্লার অংশে নছিমন ও ভটভটিও চলছে। জমিচাষের ট্রাক্টরের পেছনে ট্রলি লাগিয়ে মহাসড়ক দাবড়ে বেড়াতে দেখা গেছে।
মহাসড়কের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার অংশে দেখা দেখা গেছে, দুমুখী লেনেই উল্টো পথে চলছে তিন চাকার যান। এ কারণে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরিসহ বড় গাড়িগুলোর চালকদের হঠাৎ ব্রেক কষে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। মহাসড়কটিতে সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রায় কোথাও হাইওয়ে পুলিশের কোনো সদস্যকেও দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি।
মহাসড়কের কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ঝাগুরঝুলি এলাকায় কথা হয় বিল্লাল হোসেন নামে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে পুলিশে আমরার ওপর অনেক অত্যাচার করত। গাড়ি আটক কইরা টেকা নিত। এহন হাইওয়ে পুলিশ তেমন কোনো ঝামেলা করে না, তারা আগের মতো গাড়ি ধরে না। তাই আমরা হাইওয়ে রোডে গাড়ি চালাই। এই রোডে যাত্রী বেশি।’
মহাসড়কে এই চিত্র নজরে আনা হলে হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. খায়রুল আলম দাবি করেন, ৫ আগস্টের পর কিছু দিন সেভাবে দায়িত্ব পালন করা না গেলেও বর্তমানে হাইওয়ে পুলিশ প্রতিটি এলাকায় সক্রিয়। কার্যক্রম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তিন চাকার নিষিদ্ধ যানের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই অভিযান চলছে। আটক ও মামলা হচ্ছে। লোকবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে প্রতিনিয়ত হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা কাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে দেশের ২২টি মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপর ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ১০ জেলার মহাসড়কে তিন চাকার বাহন না চালানোর নির্দেশ দেয়; যার মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে মহাসড়কে তিন চাকার যান নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে সরেজমিনে ঘুরে ওই সিদ্ধান্ত শুধু কাগজে-কলমেই রয়েছে।
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার লালবাগ এলাকায় সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অসংখ্য অটোরিকশাকে মহাসড়কের উল্টো পথেও চলতে দেখা গেছে। চলাচল করছিল ভটভটিও। বেলা পৌনে ১১টার দিকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়া বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মহাসড়কের ওপরই গড়ে উঠেছে সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড। চৌদ্দগ্রামের হারি সর্দার এলাকায় দেখা যায়, কয়েকটি নছিমন ও ভটভটি মালামাল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলছে মহাসড়কে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা দেখা গেছে চৌদ্দগ্রাম বাজার এলাকায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকায় উল্টো পথে তিন চাকার যান চলাচলের ধুম। মহাসড়কের অন্যান্য এলাকার চিত্রও প্রায় একই।
চৌদ্দগ্রামের বাতিসা এলাকায় কথা হয় সিএনজিচালিতি অটোরিকশাচালক মহিন উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে চৌদ্দগ্রাম থানা ও মিয়ার বাজার হাইওয়ে থানা পুলিশকে প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হতো। তাঁদের কাছ থেকে টোকেন না নিলে পুলিশ গাড়ি আটকাত। ছাড়িয়ে আনতে চালকদের ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা লাগত; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বিদায়ের পর পুলিশের চাঁদা আদায় বন্ধ। এখন পুলিশ ঝামেলা না করার কারণে গাড়ি চালাতে পারছি।’
বড় যানবাহনের কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহনের দৌরাত্ম্যে তাঁদের অনেক সমস্যা হয়। ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয় তাঁদের। চৌদ্দগ্রাম বাজার এলাকায় ফেনী থেকে কুমিল্লা পথে চলাচলকারী একটি পরিবহনের বাসচালক রিপন মিয়া বলেন, ‘নিষিদ্ধ এসব যান হঠাৎ করেই সংযোগ সড়ক থেকে মহাসড়কে উঠে পড়ে। তখন জরুরি ব্রেক করলে যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আমরা এই সমস্যার সমাধান চাই।’ ট্রাকচালক ফরিদ মিয়া বলেন, হাইওয়ে পুলিশ কাজ না করার কারণে পরিস্থিতি এত খারাপ হয়েছে। তাঁরা এখন চাঁদাবাজি করে না, এ জন্য সড়কে না এসে থানায় ঘুমায়।
সড়কে অরাজকতার কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। চৌদ্দগ্রামের মিয়ার বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. শাহজাহান বলেন, কয়েক দিন আগে মিয়ার বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি সিএনজি অটোরিকশাকে চাপা দেয় ক্যাভার্ড ভ্যান। এতে একটি সিএনজির চালকসহ দুজন নিহত হয়েছেন।