ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ স্বজনদের মুখ দেখতে মেঘনাপাড়ে অপেক্ষায় তাঁরা

গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের মুঠোফোনে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন শামীম হোসেন। আজ শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের চরকিশোরগঞ্জ এলাকায়
ছবি: ফয়সাল হোসেন

ফেরিঘাটে দাঁড়িয়ে মেঘনার দিকে চেয়ে আছেন শামীম হোসেন (৪৫)। একটু পরপর ফোন আসছে তাঁর। অপর প্রান্ত থেকে ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ জানতে চাইছেন সবাই। ফোনেই তাঁদের সান্ত্বনা দিতে দিতে শামীম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখলে ঘাটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, কখনো নদীর তীরে ছুটে যাচ্ছেন। বারবার জানতে চাইছেন তাঁর ভাই সাব্বির, ভাতিজা রিমাদের কোনো খবর আছে কি না।

আজ শনিবার বেলা ১১টায় নারায়ণগঞ্জের চর কিশোরগঞ্জ ফেরিঘাটে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। গতকাল শুক্রবার বিকেলে বাল্কহেডের ধাক্কায় মেঘনা নদীতে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ আছেন শামীম হোসেনের পাঁচ স্বজন। দুর্ঘটনার পর আজ সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।

আরও পড়ুন

গত বুধবার শামীম হোসেনের ছোট ভাই সাব্বির হোসাইন (৪০), স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৩৫) ও ছেলে রিমাদকে (২) নিয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার দক্ষিণফুলদি এলাকার ভায়রা বাড়িতে বেড়াতে আসেন। সাব্বিরদের বাড়ি রংপুরের কমাছপাড়া এলায়কা। তিনি বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক।

শামীম হোসেন জানান, আজকে সাব্বিরদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। সাব্বির ও তাঁর ছেলে রিমাদ ট্রলার দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেছে। শুক্রবার রাতে বিষয়টি জানতে পেরে তিনি চরকিশোরগঞ্জ ছুটে এসেছেন। ভাই-ভাতিজাদের খুঁজে যাচ্ছেন, কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না। গ্রামের বাড়িতে স্বজনেরা আহাজারি করে যাচ্ছে উল্লেখ করে শামীম বলেন, ‘বারবার ওদের খবর জানতে চাচ্ছে। জীবিত না হোক অন্তত লাশও যদি পাই, তাহলে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারব। তাই তো ওদের খুঁজে যাচ্ছি।’

ট্রলারডুবিতে পাঁচজন নিখোঁজের খবরে স্থানীয়দের ভিড়। আজ শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের চরকিশোরগঞ্জ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, শুক্রবার বিকেলে সাব্বির ও রিমাদসহ ১১ জন ট্রলারে করে গজারিয়া থেকে মেঘনা নদীতে ঘুরতে বের হন। ঘুরতে ঘুরতে তাঁদের ট্রলার চরকিশোরগঞ্জ এলাকায় আসে। সেখানে ঘোরাঘুরি শেষে ট্রলারটি সন্ধ্যার পর গজারিয়ার দিকে যাচ্ছিল। সে সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে বালু নিতে মুন্সিগঞ্জের বালুমহালের দিকে আসছিল একটি খালি বাল্কহেড। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বাল্কহেডটি ট্রলারটিকে ধাক্কা দেয়। তৎক্ষণাৎ ট্রলারটি ১১ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় পাঁচজন তীরে উঠতে পারলেও নিখোঁজ হন ছয়জন।

শনিবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সুমনা হক (৩০) নামের এক নারীর লাশটি উদ্ধার করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তিনি গজারিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ ফুলদি গ্রামের মফিজুল হকের স্ত্রী। আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ দুর্ঘটনায় শিশুসহ পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি স্বজনদের। দুর্ঘটনায় নিখোঁজ নিহত সুমনার দুই মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া (৬) ও সাফা আক্তার (৪), দুই শিশুর চাচাতো বোন মারওয়া (৮), নিহত সুমনার দুলাভাই সাব্বির হোসাইন (৪০) ও সাব্বিরের ছেলে রিমাদ (২)।

চরকিশোরগঞ্জ ফেরিঘাট এলাকায় স্বজনদের খোঁজে এসেছেন জাহেদুল ইসলাম। তিনি নিখোঁজ জান্নাতুল মাওয়া, সাফা ও মারওয়াদের বড় চাচা। জাহেদুল বলেন, ট্রলারে ঘুরতে বের হয়ে অনেক খুশি ছিলেন তাঁরা। ট্রলার ডুবে তাঁর ছোট ভাই মফিজুল সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও তিন ভাতিজি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ঘটনার পর থেকে তাঁদের খুঁজে যাচ্ছেন। কোথাও পাচ্ছেন না।

মেঘনার পাড়ে অপেক্ষায় ট্রলাডুবিতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্বিগ্ন স্বজনেরা। আজ শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের চরকিশোরগঞ্জ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাহেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এত ছোট ছোট মুখখানি। সারা দিন বাড়িতে খেলা করত, দৌড়াদৌড়ি করত। আজকে ওরা ঘুরতে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেল। ওদের খুঁজে যাচ্ছি। ওদের মুখখানি আমরা শেষবারের মতো দেখতে চাই।’

বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক (নারায়ণগঞ্জ বন্দর) ওবায়দুল করিম খান প্রথম আলোকে বলেন, নদীতে প্রচণ্ড রকমের স্রোত। নদীর গভীরতা ১২০ ফুটের ওপরে। সেই সঙ্গে কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টি হচ্ছে। এতে উদ্ধার তৎপরতা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সম্ভাব্য স্থানগুলোতে কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএ, নৌ পুলিশের সদস্য ও ডুবরিরা কাজ করে যাচ্ছেন। যে পর্যন্ত নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোনো সন্ধান পাওয়া না যাবে, সে পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা চলতে থাকবে।