সকাল ৬টা বেজে ২৫ মিনিট। সূর্য তখনো ভালো করে ওঠেনি। বৃহস্পতিবার সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের উত্তর দিকে সারি ধরে দাঁড়িয়ে ও বসে ছিলেন একদল নারী। অপেক্ষা সকাল নয়টার খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির (ওএমএস) ট্রাকের। নারীদের সারির উত্তর পাশে পুরুষের সারিতে কেউ নেই। কাছে গিয়ে দেখা গেল, মাটিতে দাগ আঁকা। পাশের চায়ের দোকানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুরুষেরা মাটিতে দাগ দিয়ে সিরিয়াল দিয়ে নিজেদের কাজকর্ম করছেন।
চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুহিবুর রহমান। সকাল ছয়টায় এসে তিনি ৬ নম্বর সিরিয়াল নিয়েছেন। এক নম্বরে থাকা ব্যক্তি নাকি রাত সাড়ে তিনটায় এসেছেন বলে শুনেছেন। মুহিবুর রহমান বলেন, আলিয়া মাঠসংলগ্ন বাসাবাড়ির লোকজন ও পাশের মাইক্রোবাসস্ট্যান্ডের চালকেরা সকাল সকাল এসে সারিতে দাগ এঁকে চলে যান। এ জন্য নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজন সারির পেছনে পড়ে যান। চাল ও আটা নিয়ে সকাল নয়টার দিকে ট্রাক আসে। এরপর বিক্রি শুরু হয়। ভোরে এলেও দুই থেকে তিন ঘণ্টা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ জন্য দাগ এঁকে আশপাশে একটু হাঁটাহাটি করেন অনেকে।
পুরুষের সারির প্রথমে থাকা ব্যক্তিকে আশপাশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কথা হয় নগরের আম্বরখানা এলাকার মহরম আলীর (৪০) সঙ্গে। বলেন, সকাল ছয়টার দিকে এসে ১০ জনের পর সিরিয়াল পেয়েছেন। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। পরিবারে সদস্যসংখ্যা ছয়জন। তাঁর আয়েই চলে সংসার। এর মধ্যে যেদিন ওএমএসের চাল ও আটা কিনতে আসেন, সেদিন কাজে যেতে পারেন না। সারিতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কাজের সময় চলে যায়।
নারীদের সারির প্রথম দিকে দাঁড়িয়ে থাকা নগরের মজুমদারি এলাকার নাসিমা বেগম (২৭) বলেন, সপ্তাহে দুবার তিনি ওএমএসের চাল ও আটা কিনতে আসেন। পাঁচ সদস্যের সংসার স্বামীর দিনমজুরি ও তাঁর টেইলার্সের কাজের আয় দিয়ে চলে। বাজারে চাল-আটার দাম বেশি থাকায় এখান থেকে কেনেন। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে দুবার সকাল ১০টায় এসে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। এ জন্য আজ ফজরের আজানের পরপরই মাকে নিয়ে চলে আসেন। মাঠে এসে নারীদের সারিতে কাউকে পাননি। তবে পুরুষের সারিতে তিন থেকে চারজনকে পেয়েছেন।
সারির তিন নম্বরে থাকা জানু বেগম (৪৫) বলেন, নারীদের সারিতে ঝামেলা বেশি হয়। এ জন্য কেউ সারি ছাড়তে চান না। ট্রাক আসার পর ঝামেলা বেশি হয়। অনেকে পরে এসেও সামনে চলে যান। গত রোববার তাঁর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। পরে ট্রাকের লোকজন সমাধান করে দেন।
জানু বেগমের সঙ্গে কথার ফাঁকে খায়রুন নেছা নামের এক বৃদ্ধা সারির সামনে চলে আসেন। এ নিয়ে হইচই শুরু হয়। পরে ওই বৃদ্ধাকে বয়স বিবেচনায় সারিতে থাকা সবাই সারির সামনে রাখতে রাজি হন। খায়রুন নেছার বয়স ১০০ বছরের বেশি বলে দাবি করেন। এর মধ্যে পুরুষের সারির প্রথমে থাকা ব্যক্তি চলে আসেন।
কেতুকী রঞ্জন নাথ (৫৭) নামের ওই ব্যক্তি বলেন, মাঠের পাশেই তাঁর বাসা। কথা বলে বোঝা গেল, তিনি অসুস্থ। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের নাম মনে করতে পারছিলেন না। কেতুকী বলেন, ২০০২ সালে তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হন। এরপর শরীরের ডান পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছিল। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তবে এখন অনেক কিছুই মনে থাকে না। তবে রাত সাড়ে তিনটায় মাঠে এসে দাগ এঁকে চলে গিয়েছিলেন বলে জানান।
সারিতে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা বলেন, যে পরিমাণ আটা ও চাল দেওয়া হয়, তা চাহিদার তুলনায় কম। ট্রাকে বিক্রির তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এ জন্য সারিতে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়েও অনেককে খালি হাতে ফিরতে হয়। ক্রেতারা ওএমএসের মালামাল বাড়ানোর দাবি জানান।
সিলেট জেলা খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহে পাঁচ দিন করে সিটি করপোরেশনের ২১টি পয়েন্টে ওএমএসের পণ্য বিক্রি করা হয়। বর্তমানে প্রত্যেক ডিলারকে এক টন করে চাল ও আটা দেওয়া হয়। একজন ক্রেতা ২৪ টাকা কেজি দরে পাঁচ কেজি আটা ও ৩০ টাকা দরে পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারেন।
সকাল ১০টার দিকে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে গিয়ে দেখা গেল, ওএমএসের ট্রাকের পেছনে পুরুষ ও নারীদের সারি দীর্ঘ হয়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা বেশি। ট্রাকে মালামাল দিচ্ছিলেন আবদুর রউফ নামের ডিলার। পাশে ক্রেতাদের স্বাক্ষর ও আঙুলের ছাপ নিচ্ছিলেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক অমর দাশ। সকাল ১০টায় ৫৫ জনকে চাল ও আটা দেওয়া হয়েছিল।
ক্রেতা আমিন আহমদ (৩০) বলেন, সকাল সাতটায় চাল ও আটা নিতে সারিতে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর সামনে সকাল ১০টা পর্যন্ত ১০ জন দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, পাশে মাইক্রোবাসস্ট্যান্ড হওয়ায় চালকেরা সারি ছাড়াই সামনে দাঁড়িয়ে চাল ও আটা নিয়ে যান। প্রতিবাদ করলে সবাই একত্র হয়ে কটূক্তি করেন।
ট্রাক তদারকির দায়িত্বে থাকা জেলা খাদ্য কার্যালয়ের উপপরিদর্শক সুমন গোপ বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারি বাড়তে থাকে। একজন ডিলারের এক টন চাল ও এক টন আটা বরাদ্দ থাকে। বরাদ্দের বাইরে বিক্রির সুযোগ নেই। এ জন্য অনেককে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।