এক খাটিয়া আনতে গিয়ে লাশ হলেন ৩ জন, পরে একসঙ্গে ৪ জনের শেষযাত্রা
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় বার্ধক্যের কারণে মৃত্যু হয় নূরি বেগমের (৭০)। তাঁর দাফন-কাফনের প্রস্তুতি চলছিল। লাশ বহনের জন্য একটি খাটিয়া আনতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হন তাঁর নাতিসহ তিনজন। পরে চারটি খাটিয়ায় চারজনের লাশ তুলে একসঙ্গে জানাজার জন্য নেওয়া হয় স্থানীয় একটি মাঠে।
চারজনের শবযাত্রায় যোগ দেন আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ। জানাজা শেষে গতকাল বুধবার লাশ চারটি পৃথক দুটি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
একটি লাশের খাটিয়া আনতে গিয়ে ট্রাকচাপায় তিনজনের নিহত হওয়ার ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার কালনা এলাকায় ঢাকা-যশোর মহাসড়কে ট্রাকচাপায় তিনজন মারা যান। নিহত তিনজন হলেন মাইটকুমড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা দিনমজুর জিয়া বিশ্বাস (৩৮), লোহাগড়া ইউনিয়নের কালনা আমতলা গ্রামের রাসেল মোল্লা (১৫) ও প্রাইভেট কারের চালক শামীম শেখ (৩২)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন কালনা আমতলা গ্রামের তুহিন শেখ (৩০)।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কিশোর রাসেল মোল্লা জয়পুর আলিয়া মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তাঁর দাদি নূরি বেগম মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে মারা যান। রাসেল প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে দাদির লাশ বহনের জন্য খাটিয়া আনতে গিয়েছিল। রাসেলের বাবা জামাল মোল্লা বর্গাচাষি। নিজেদের জমিজমা নেই। রাসেলরা দুই ভাই। আরেক ভাই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। সম্প্রতি ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছেন। রাসেলও বাবাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করত। কিশোর রাসেলকে হারিয়ে আহাজারি থামছেই না পরিবারের সদস্যদের।
রাসেলের মা পপি বেগম শোকে কাতর হয়ে গেছেন। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, কণ্ঠস্বর আটকে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বললেন, ‘বাবা খাটিয়া আনতে গেল, আর ফিরে আসেনি।’
নিহত জিয়া বিশ্বাস দিনমজুরির কাজ করতেন। আবার ভাঙারি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। তাঁর পরিবারের বসবাস সরকারের মাইটকুমড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে। তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে। বড় ছেলে রনি বিশ্বাস (১৮) শ্রমজীবী। মেয়ে রিমি খানম দশম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারটি এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছে। বাবার মৃত্যুতে আক্ষেপ করে রনি বিশ্বাস বললেন, মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেল। এখন কীভাবে বেঁচে থাকবেন?
নিহত শামীম শেখ পরিবারের একমাত্র ছেলেসন্তান। বোন শান্তার বিয়ে হয়ে গেছে। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মা–বাবাকে নিয়ে ছিল তাঁদের সংসার। শামীমের আয়েই পরিবারটি চলত। সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বৃদ্ধ মা-বাবা। মা সবেজান বেগম ঘরের বিছানায় শুয়ে আহাজারি করছিলেন, বলছিলেন, ‘খাটিয়া আনতে যাচ্ছি বলে বাড়ি থেকে বের হলো। সেই খাটিয়াতে উঠেই চিরতরে চলে গেল। আমার দুনিয়ায় কেউ থাকল না।’
শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল বাবা হেমায়েত শেখ বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে কে এখন দেখবে?’
একই গ্রামের বাসিন্দা ও লোহাগড়ার জয়পুর আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. বদরুল ইসলাম বলেন, একসঙ্গে তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে পরিবারের পাশাপশি এলাকাবাসীও শোকাহত। লোহাগড়া বাজার থেকে কালনা পর্যন্ত চার কিলোমিটার সড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এটি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। ঢাকা-যশোর মহাসড়কের এই অংশটিতে প্রতিদিন শত শত গাড়ি চলে। চালকেরা মনে হয় বেসামাল হয়ে গাড়ি চালান। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কটি চওড়া করা দরকার।