মৎস্যবিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার

মাছের শুক্রাণু সংরক্ষণ প্রযুক্তির ফলে রক্ষা হবে বিশুদ্ধতা, বাড়বে উৎপাদন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম সরদার। তাঁর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো দেশে মাছের শুক্রাণু শত বছর বা তারও বেশি সময় সংরক্ষণের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রযুক্তিটির নাম ‘ক্রায়োপ্রিজারভেশন’। এতে মাছের প্রজাতির বিশুদ্ধতা রক্ষা হবে, পাশাপাশি উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি এবং ওই গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরান পারভেজ ও ইসরাত জাহান

অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম সরদার
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

গবেষণাটি কবে থেকে শুরু হয়? আর্থিক সহযোগিতা করেছে কারা?

রফিকুল ইসলাম সরদার: ২০০২ সাল থেকে মাছের শুক্রাণু সংরক্ষণের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। এককভাবে কোনো আর্থিক সহযোগিতার উৎস ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি প্রকল্পের অর্থায়নে গবেষণা হয়েছে। ২০২০ সালে প্রথম মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়। স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী এই গবেষণায় কাজ করেছেন। বর্তমানে ‘ক্রায়োজেনিক স্পার্ম ব্যাংকিং অব ইন্ডিয়ান মেজর কার্পস অ্যান্ড এক্সোটিক কার্পস ফর কমার্শিয়াল সিড প্রোডাকশন অ্যান্ড ব্রুড ব্যাংকিং’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এই প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এতে অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডি ও ফিড দ্য ফিউচার ইনোভেশন ল্যাব ফর ফিশ। মৎস্য অধিদপ্তরও এতে সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগ ও যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি অ্যাগ্রিকালচার সেন্টারের অ্যাকুয়াটিক জার্মপ্লাজম অ্যান্ড জেনেটিক রিসোর্সেস সেন্টার যৌথভাবে এ ‘ক্রায়োপ্রিজারভেশন’ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।

প্রশ্ন:

কোন কোন প্রজাতির মাছে এই প্রযুক্তি ফলপ্রসূ এবং কত শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে?

রফিকুল ইসলাম সরদার: বর্তমানে কাতলা, রুই, মৃগেল, সিলভার, বিগহেড ও গ্রাস কার্প—এই ছয় প্রজাতির মাছের ওপর গবেষণা চালিয়ে সাফল্য পাওয়া গিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ হ্যাচারি যেসব শুক্রাণু থেকে মাছের পোনা উৎপাদন করে, তার চেয়ে এই সংরক্ষিত শুক্রাণু থেকে উৎপাদিত মাছের পোনার বর্ধন বেশি। মাছগুলোর আকার তুলনামূলক বড়, গঠনও সুন্দর। রোগবালাইয়ে খুবই কম আক্রান্ত হয়। ফলস্বরূপ উৎপাদন প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। তবে ওই ছয় প্রজাতি ছাড়া অন্য সব প্রজাতির মাছেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে।

প্রশ্ন:

শুক্রাণু সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় লক্ষণীয়?

রফিকুল ইসলাম সরদার: হ্যাচারিগুলোয় আন্তপ্রজনন বেশি হয়। ফলে মাছের ভালো জিনগুলো চাপা পড়ে যায়। আবার সংকরায়ণের শিকার মাছগুলোয় মিশ্র বৈশিষ্ট্য থাকে। সে ক্ষেত্রেও বিশুদ্ধ জিন পাওয়া যায় না। ভালো পোনা উৎপাদন করতে হলে বিশুদ্ধ প্রজাতির মাছ থেকে শুক্রাণু সংরক্ষণ করতে হবে। এই গবেষণায় হালদা ও পদ্মা থেকে কাতলা, রুই ও মৃগেল এবং চীন থেকে সিলভার, বিগহেড ও গ্রাসকার্প মাছের বিশুদ্ধ প্রজাতি আহরণ করে সেগুলো থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেসব বিশুদ্ধ শুক্রাণু দিয়ে দেশের ময়মনসিংহ, যশোর, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করা হয়। মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনের ভেতর যত দিন রাখা যাবে, তত দিনই শুক্রাণু ঠিক থাকবে। তবে কিছুদিন পরপর সংরক্ষণ তরলের পরিমাণ পরিদর্শন করা জরুরি। পানির মতো হওয়ার এটি খালি চোখেই দেখা যায়। সংরক্ষণের পাত্রে তরলের পরিমাণ কমে গেলে পুনরায় নির্দিষ্ট পরিমাণ সরবরাহ করতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে লাভবান হবেন?

রফিকুল ইসলাম সরদার: গবেষণার ফলাফল ও উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সেখান থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মাছচাষিদের কাছে এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়বে।

প্রশ্ন:

সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে ‘ক্রায়োপ্রিজারভেশন’ কি সম্ভব?

রফিকুল ইসলাম সরদার: বর্তমানে যে প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে, সেখানে শুধু স্বাদু পানির মাছ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তবে সামুদ্রিক মাছেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। সে ক্ষেত্রে সংরক্ষণ তরল, তাপমাত্রা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যে কিছু পরিবর্তন আনতে হতে পারে।

প্রশ্ন:

সংরক্ষণ তরলের পিএইচ কেমন হওয়া জরুরি?

রফিকুল ইসলাম সরদার: পিএইচ অর্থাৎ সংরক্ষণ তরলের অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব ঠিকঠাক বজায় রাখা শুক্রাণু সংরক্ষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সংরক্ষণ তরলে নাইট্রোজেনের সঙ্গে আরও দুটি রাসায়নিক উপাদান সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং সোডিয়াম সাইট্রেট যুক্ত করা হয়। যে মাছের শুক্রাণু নেওয়া হচ্ছে, তার শরীরের পিএইচ এবং সংরক্ষণ তরলের পিএইচ সমান রাখা জরুরি। পরবর্তী সময়ে পোনা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও জলাধারকে একই পিএইচ–বিশিষ্ট করে নিতে হবে।

প্রশ্ন:

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ‘ক্রায়োপ্রিজারভেশন’ চালুর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কোথায় কোথায় ছিল?

রফিকুল ইসলাম সরদার: বিশ্বের অন্যান্য দেশে অনেক আগে থেকেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি শুরুর অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ছিল বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির অভাব। ২০০২ সালে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। কিন্তু সে সময় তরল নাইট্রোজেন সরবরাহ খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। বাসে করে ঢাকা থেকে তরল নাইট্রোজেন নিয়ে আসা হতো। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামেরও জোগান ছিল না সে সময়।

প্রশ্ন:

ক্ষয়কারী রাসায়নিক দ্রবণে সংরক্ষণকৃত শুক্রাণু দিয়ে উৎপন্ন মাছ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ?

রফিকুল ইসলাম সরদার: সংরক্ষণের সময় পাত্রে বদ্ধ করে নাইট্রোজেনকে সংরক্ষণ করা হয়। বাতাসের সংস্পর্শে এলেই এটি উড়ে চলে যায়। সংরক্ষণ তরল ক্ষয়কারী হওয়ায় কাজের সময় মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা জরুরি। তবে উৎপাদিত মাছ স্বাস্থ্যের জন্য একেবারেই নিরাপদ। এই প্রযুক্তির ব্যবহারে মাছের বর্ধন বাড়বে। তবে সেখানে অস্বাভাবিক বর্ধন বা গঠন হবে না। চিরাচরিত ধারা থেকে তুলনামূলক লাভজনকভাবে মাছ চাষ করতে পারবেন কৃষকেরা।