চট্টগ্রামের সাত উপজেলায় নেই প্রাণিচিকিৎসক

চট্টগ্রাম জেলার মানচিত্র

মাস তিনেক আগের ঘটনা। ফটিকছড়ি উপজেলার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিনের খামারে একটি গরুর পেট হঠাৎ ফুলে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গরুটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে যোগাযোগ করেন তিনি; কিন্তু কোনো চিকিৎসক আসেননি। গরুটাকে বাঁচানো যায়নি।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ জয়নাল আবেদিন প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে গবাদিপশুর কোনো চিকিৎসাই তিনি পাচ্ছেন না। গরুর কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলেন। লাভ হয়নি, কেউ আসেননি। আবার হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাওয়া যায়নি।

ফটিকছড়ি উপজেলায় প্রতিদিন গড়ে ৭০ জনের মতো স্থানীয় বাসিন্দা গরু-ছাগল নিয়ে হাসপাতালে আসেন; কিন্তু সেখানে এক বছর ধরে কোনো প্রাণিচিকিৎসক (ভেটেরিনারি সার্জন) ছিলেন না। মাস দুয়েক আগে একজন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে গত ১৪ জুলাই তিনি যোগদান করেন; কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে খামারি ও প্রান্তিক কৃষকেরা সেবা পাননি। এ ছাড়া দক্ষ টেকনিশিয়ান না থাকায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না আলট্রাসনোগ্রাফির যন্ত্রটিও।

জনবলসংকটের কারণেই মূলত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন ফটিকছড়ি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুচয়ন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় ৫০০ খামারি। পাশাপাশি প্রায় ৮০ হাজার পরিবারে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি লালনপালন করা হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন শতাধিক প্রাণীর চিকিৎসা ও পরামর্শের প্রয়োজন হয়; কিন্তু প্রায় এক বছর ধরে কোনো ভেটেরিনারি সার্জন ছিলেন না। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

ফটিকছড়িতে সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া হলেও চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার ৭টিতেই প্রাণিচিকিৎসকের (ভেটেরিনারি সার্জন) পদ খালি পড়ে আছে। চট্টগ্রাম নগরের দুটি মেট্রো হাসপাতালেও প্রাণী চিকিৎসক নেই। ফলে নগরের খামারের পশু ও ঘরের পোষ্য প্রাণী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

উপজেলার প্রাণী হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাফির যন্ত্র স্থাপন করা হলেও চিকিৎসক নেই বলে তা ব্যবহারের পরামর্শ পাচ্ছেন না খামারিরা। এ ছাড়া কোনো হাসপাতালেই এক্স-রে যন্ত্র নেই। রক্ত পরীক্ষাও হয় সীমিত। এ কারণে গবাদিপশু ও প্রাণী নিয়ে খামারি ও কৃষকদের ছুটতে হয় চট্টগ্রাম নগরের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) এ এস কাদেরি ভেটেরিনারি হাসপাতালে। এতে খরচ যেমন বেশি পড়ছে, তেমনি চিকিৎসার সময়ও বেশি লাগছে।

খামারিরা বলছেন, বিভিন্ন মৌসুমে গবাদিপশু, হাঁস, মুরগির ১০ থেকে ১২ ধরনের রোগ হয়। এসব রোগ নিরাময়ে খামারিদের ভরসা ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতারা। ফলে এ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনেও অনেক ওষুধ কিনতে হয়। ওষুধের ভুল ও যথেচ্ছ প্রয়োগ তো আছেই, সব মিলিয়ে বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকি থাকে সব সময়।

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় প্রাণী হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুমোদিত পদসংখ্যা ১৬৫। এর মধ্যে ১১০ জন কর্মরত। পদ শূন্য রয়েছে ৫২টি। ড্রেসারের ১৫টি পদে মাত্র তিনজন কর্মরত। হাসপাতালগুলোতে প্রশিক্ষণ, খামার স্থাপনে কারিগরি সহায়তা, জাত উন্নয়নে গরু-মহিষের কৃত্রিম প্রজনন, গবাদিপশু ও পোলট্রির টিকাদান ও চিকিৎসা দেওয়া হয়।

চিকিৎসক নেই সাত উপজেলায়

সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, হাটহাজারী, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলার সরকারি প্রাণী হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক (ভেটেরিনারি সার্জন) নেই। অন্যদিকে ফটিকছড়ি ও মিরসরাইয়ে গত মে মাসে প্রাণিচিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আট মাস থেকে চার বছর পর্যন্ত পদগুলো খালি।

চিকিৎসক না থাকার বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রেয়াজুল ও প্রশাসন শাখার পরিচালক মলয় কুমার শূর সম্প্রতি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বিসিএস থেকে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগপ্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ার কারণে দেখা যায়, একবার নিয়োগ দিতে দিতে আবার পদ খালি হয়ে যাচ্ছে। কেউ পদোন্নতি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে খালি হয়ে যাচ্ছে এসব পদ। তবে শিগগির এসব উপজেলায় চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে। তখন আর সংকট থাকবে না।

চিকিৎসক নেই, রোগীও নেই

গবাদিপশু ও বিভিন্ন পোষা প্রাণীর চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম নগরে তিনটি মেট্রো প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দুটিতেই কোনো ভেটেরিনারি সার্জন নেই। এসব দপ্তরে নামে মাত্র চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। সম্প্রতি নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় পাঁচলাইশ মেট্রো প্রাণিসম্পদ দপ্তরে গিয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দপ্তরের দুয়ারে তালা ঝুলছিল। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেও কোনো রোগীর সাক্ষাৎ মেলেনি। সিটি করপোরেশনের কর কার্যালয়ের দ্বিতীয়তলায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে চলছে এ দপ্তরের কার্যক্রম। মাসে ১৮ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়।

পাঁচলাইশ মেট্রো দপ্তরের উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (সম্প্রসারণ) মোহাম্মদ জহুরুল ইসলামও সেবার ঘাটতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ছয় মাস ধরে ভেটেরিনারি সার্জন নেই। যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে। প্রশাসনিক কাজে থাকলে চিকিৎসা দেওয়া যায় না। অন্যদিকে কোতোয়ালি মেট্রো প্রাণিসম্পদ দপ্তরেও ভেটেরিনারি সার্জন নেই। এ পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন কর্ণফুলী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রুমন তালুকদার। এ হাসপাতালের প্রাণীদের শেডটিও প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

উপজেলার খামারি ও প্রান্তিক কৃষককে মানসম্মত সেবা দিতে দ্রুত চিকিৎসক দিতে হবে বলে মনে করেন সিভাসুর এ এস কাদেরি ভেটেরিনারি হাসপাতালের পরিচালক ভজন চন্দ্র দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা পর্যায়ে ভেটেরিনারি সার্জনের পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পদ শূন্য থাকলে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া কঠিন। চট্টগ্রামের উপজেলাগুলো থেকে গবাদিপশু ও পোষা প্রাণী নিয়ে যাঁরা সিভাসুতে আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তাই দ্রুত নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।