গণপিটুনির কোনো ঘটনার কথা জানেন না এলাকার মানুষ

বাড়ির নিচতলায় নির্বাক বসে আছেন আরিফুজ্জামান রূপমের বাবাসহ স্বজনেরা। আজ মঙ্গলবার খুলনা নগরের দৌলতপুর আঞ্জুমান মসজিদ সড়ক এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

খুলনায় সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের ভাগনে শেখ আরিফুজ্জামান রূপমের (৩৪) মৃত্যুসনদে লেখা হয়েছে ‘পাবলিক অ্যাসল্ট’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ‘গণপিটুনিতে’ তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে খুলনা নগরের দৌলতপুর আঞ্জুমান মসজিদ সড়ক এলাকার বাসিন্দারা গতকাল সোমবার কোনো ধরনের গণপিটুনি বা গোলযোগের ঘটনা ঘটার কথা জানেন না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, গতকাল ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত খুলনা নগরের দৌলতপুরের আঞ্জুমান রোড এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় আরিফুজ্জামান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন স্থানীয় লোকজন তাঁকে ধরে পিটুনি দেন। পরে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরের আঞ্জুমান মসজিদ সড়কের আমতলা মোড়ে রূপমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চারতলা ওই বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। ওই বাড়িতে রূপমের মা, বাবা, দুই ভাই, এক বোন ও স্ত্রী থাকেন। লাশ তখনো বাড়িতে এসে পৌঁছায়নি। নিচতলায় বসে ছিলেন রূপমের বাবা। লোকজন এসে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তবে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।

সেখানে কথা হয় রূপমের ছোট চাচা মো. ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি পেশায় চায়ের দোকানি। ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চোখের সামনের ঘটনা। রূপমকে বাইরে থেকে ধরে নিয়ে আসে। হাত পেছন দিকে বাঁধা। দোতলায় নিয়ে গিয়ে যে টর্চার করেছে, তার শব্দ আমরা পাই। এ অবস্থায় (সোমবার সকাল) সাড়ে ৯টা-পৌনে ১০টার দিকে দোতলা থেকে চারজন মিলে ধরে নিয়ে গাড়ির ভেতরে ফেলে দেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও বেশ কিছু বাহিনীর গাড়ি ছিল।’

আরও পড়ুন

ফরহাদ হোসেন আরও বলেন, ‘ফজরের আজানের সময় দোকান খুলি। না হলে সেদিন আর খুলি না। আমি দুধ–চা বেচি না। অন্য দোকান থেকে গুঁড়া দুধ কিনে অফিসারদের চা বানিয়ে খাইয়েছি। মুসল্লিরা চা খেতে দোকানে এলে যৌথ বাহিনীর লোকজন তাঁদের পরে আসতে বলেন। আমার দোকানে অন্য কাস্টমার কাল সকালে ঢোকেনি। কাল কোনো গ্যাঞ্জাম–ফ্যাসাদ কিছু হয়নি।’

রূপমদের প্রতিবেশী নাসির উদ্দীন বলেন, কাল এলাকায় কোনো মারামারি, গ্যাঞ্জাম, হাতাহাতি কিছুই হয়নি। যৌথ বাহিনীর ১০ থেকে ১২টা গাড়ি ছিল। গণপিটুনির যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, এগুলোর কোনো বালাই নেই।

খুলনা নগরের দৌলতপুর আঞ্জুমান মসজিদ সড়ক এলাকায় শেখ আরিফুজ্জামান রূপমদের বাড়ি। আজ মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

রূপমের এক স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রূপমকে ধরে দুইতলায় নেওয়ার পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাঁর ভাই-মা-বাবাকে আটকে রাখা হয় তখন। ব্যাপক মারধর করা হয় রূপমকে। একসময় রূপম বলেছে, ‘স্যার, আমাকে আর মাইরেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না।’ একটা সময় রূপম নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। তাঁর স্ত্রীকে তখন জিজ্ঞাসা করা হয়, রূপমের কোনো অসুখ আছে কি না। প্রেশার একটু লো ছাড়া কিছু নেই জানালে তারা স্যালাইন চায়। পানির বালতির মধ্যে রক্তবমি ছিল। তারা সম্ভবত জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেছিল, তবে পারেনি। তারপর তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে চলে যায়।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

রূপমদের বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়া নাজমা বেগম বলেন, ‘মনে করছিলাম রূপমের বাবা চাল–আটা বিক্রি করে, এর কোনো তদন্তে বোধ হয় আসছে। তখন ছয়টা-সোয়া ছয়টা বাজে। গেটে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতে বলে। আমি বলেছিলাম, গেটের চাবি আমার কাছে নাই। রূপমের বোন ওপর থেকে এসে খুলে দেয়। আমার ঘরে ২০ থেকে ২৫ জন ঢুকে বলে, কোথাও যাওয়া যাবে না। আমার প্রসূতি মেয়েটা ঘরে ছিল। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখে। সাধারণ পোশাক পরা লোকজন ছিল। ঘরের ভেতর দুজন, আর সিঁড়ির মুখে ৫ থেকে ৭ জন বসেই ছিল। রূপমরে দুইতলায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে কী হয়েছে, তা বলতে পারব না। একটা সময় আমি বলেছি, রূপমকে কি নিয়ে যাবেন? তখন তারা বলে, “না, কিছুই পাইনি, নেব না।” রূপমকে যখন বের করে, ঠিক তখন কয়েকজন আমার ঘরে এসে তল্লাশি চালায়।’

আরিফুজ্জামান রূপম
ছবি: সংগৃহীত

এলাকার কম করে ২০ জন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই এলাকায় গতকাল কোনো গোলযোগের ঘটনা ঘটেনি।

দৌলতপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতাল সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে তিনি (আরিফুজ্জামান) গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন। ঘটনার একপর্যায়ে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’ তিনি বলেন, ‘সুরতহালে আমরা দেখতে পেয়েছি, নিহত ব্যক্তির শরীরের বেশ কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন ছিল। যতটুকু চিহ্ন দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, তা একজন মানুষ মারা যাওয়ার মতো।’

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আরিফুজ্জামান রূপমের বিরুদ্ধে মাদকসহ চারটি মামলা রয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দৌলতপুর থেকে ১৮টি ইয়াবা বড়িসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। এর আগে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর দিঘলিয়া উপজেলার পানিগাতী গ্রাম থেকে আরিফুজ্জামানসহ দুজনকে ৩৯৫টি ইয়াবাসহ আটক করেছিল র‌্যাব।

এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে রূপম সম্পর্কে দুই রকম তথ্য পাওয়া যায়। একটা দলের ভাষ্য, রূপম একসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতেন। পরে দেশে ফিরে গরু, ছাগল-গাড়লের খামার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। অন্য দল বলছে, রূপম নিজেই মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া খালার প্রভাবে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।

আজ বেলা আড়াইটার দিকে রূপমদের বাড়িতে আবার গিয়ে দেখা যায়, তাঁদের নতুন এই বাড়ির কিছুটা দূরে পুরোনো বাড়িতে লাশ গোসল করানো হচ্ছে। সেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড়। পাশে পারিবারিক কবরস্থানে কবর খোঁড়ার কাজ চলছিল।

রূপমের নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোনো মামলা হয়নি। দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী জানান, মারা যাওয়ার পর তাঁরা ঘটনা জানতে পারেন। হাসপাতালের মৃত্যুসনদে ‘পাবলিক অ্যাসাল্ট’ লেখা আছে। ওসি আরও বলেন, লাশের সুরতহাল হয়েছে, ময়নাতদন্ত চলছে। তদন্ত করলে সব বিষয় স্পষ্ট হবে আর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা না হলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।