তিনবারের ইউপি সদস্য এখলাছ কাপড় ইস্তিরি করে সংসার চালান
চারবার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে অংশ নেন নেত্রকোনার মদন উপজেলার মো. এখলাছ মিয়া (৪৯)। এর মধ্যে তিনবার ভোটে নির্বাচিত হন। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু এখনো কাপড় ইস্তিরি করেই সংসার চালান এখলাছ। এ জন্য এলাকার মানুষের কাছে তিনি ‘ইস্তারি মেম্বার’ হিসেবে পরিচিত। দোকানে কাপড় ইস্তিরি করার সময় মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা জাগে তাঁর। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর পেশা বাদ দেননি।
এখলাছ মিয়া মদন উপজেলার চানগাঁও ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
স্থানীয় লোকজন ও এখলাছ মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাত ভাইবোনের মধ্যে এখলাছ সবার ছোট। অভাব-অনটনের সংসারে তিনি বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি। স্থানীয় রত্নপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে জীবিকার তাগিদে বাবা ও ভাইদের সঙ্গে অন্যের জমিতে কৃষিকাজে মন দেন। এ থেকে যা আয় হতো, তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলত। মা-বাবার মৃত্যু, ভাইয়েরা বিয়ে করে পৃথক হওয়ার পর কৃষিকাজ ছেড়ে তিনি কাপড় ইস্তিরির দোকান দেন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি এ কাজ করছেন।
মদন উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে এখলাছের কাপড় ইস্তিরির দোকান। দোকানের আয়েই চলে তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসার। স্ত্রী ইসরাত জাহান গৃহিণী, একমাত্র মেয়ে ফারজানা আক্তার স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী, বড় ছেলে শরীফ মিয়া একাদশ শ্রেণিতে পড়ে এবং ছোট ছেলে আরিফ মিয়া অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
এখলাছ মিয়া বলেন, দোকানে কাপড় ইস্তিরি করতে করতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিজের ও অন্যদের অভিজ্ঞতায় জেনেছেন, অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে ভোটের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন না। তাই তাঁর ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা জাগে। ২০০৩ সালে ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে প্রথম অংশ নিয়ে তিনি জয়ী হন। তারপর ২০১১ সালে একই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কয়েক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। ২০১৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি আবারও জয়ী হন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি তৃতীয়বারের মতো ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন।
ওয়ার্ডের চকপাড়া এলাকার লালন মিয়ার স্ত্রী শিউলী আক্তার (৩২) বলেন, ‘আমার অভাবের সংসার। কেউ সহায়তা করেননি। এখলাছ মেম্বারের কাছে গিয়া কষ্টের কথা কইলে তিনি সব শুইন্না আমারে ভিজিডি কার্ড কইরা দিছেন। অহন আমি প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাউল পাই।’ ভিজিডির সুবিধা করে দেওয়া একই এলাকার নজুফা আক্তার নামের আরেক নারী বলেন, ‘এখলাছ মেম্বার গরিব মানুষের জন্য কাজ করেন। এমন মেম্বারই আমরা চাইছিলাম।’
চানগাঁও নাগপাড়া এলাকার বৃদ্ধ আবদুল কাদির (৬৮) সমাজসেবা কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরেও বয়স্ক ভাতা পাচ্ছিলেন না। বিষয়টি শুনে ইউপি সদস্য এখলাছ মিয়া প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। দেড় বছর ধরে তিনি ভাতা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এখলাছ মেম্বর গরিবের কষ্ট বোঝেন। তাই আমার বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করে দিছেন। তিনি সৎ মানুষ, কাপড় ইস্তারির কাজ কইরা কষ্টে সংসার চালান।’
এখলাছ মিয়ার স্ত্রী ইসরাত জাহান বলেন, ‘আমার স্বামী তিনবার মানুষের ভোটে মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে আমাদের বাড়তি কোনো টাকাপয়সা খরচ করতে হয়নি। আর খরচ করার মতো টাকাপয়সাও আমাদের নেই। তিনি কাপড় ইস্তিরি করে কষ্টে সংসার চালান। তিন সন্তান কলেজ ও স্কুলে লেখাপড়া করে। সংসারের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু যখন দেখি মানুষ তাঁকে সম্মান ও ভালোবাসে, তখন আর কোনো আক্ষেপ থাকে না।’
পরিষদের সচিব রাজিব সরকার বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে এই পরিষদে কাজ করছি। ইউপি সদস্য এখলাছ মিয়া খুবই জনপ্রিয়। সাধারণ মানুষের ডাকে তিনি সাড়া দিয়ে সব সময় পাশে থাকেন। তাঁর নামে কোনো বদনাম নেই।’
চানগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান নুরুল আলম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তিনবার চেয়ারম্যান হয়েছি, ওই তিনবার এখলাছও মেম্বার হয়েছেন। পরিষদের বরাদ্দ অনুযায়ী তাঁর ওয়ার্ডে যা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তা তিনি সঠিকভাবে বিতরণ করেন। তাঁর কার্যক্রমে ওই ওয়ার্ডের মানুষ সন্তুষ্ট।’
এখলাছ মিয়া বলেন, ‘সুখে-দুঃখে এলাকার মানুষের পাশে থেকে সাধ্যমতো কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিজের পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে কাপড় ইস্তিরির কাজ করে আসছি। প্রতিদিন গড়ে ইস্তিরি করে ৫০০ টাকার মতো পাই। কিন্তু ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। পরিষদের আয় না থাকায় শুধু সরকারি ভাতাটুকু পাই। তবে ভোটারদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে বারবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। আমি যত দিন বেঁচে আছি, তাঁদের জন্য কাজ করে যেতে চাই।’