‘সন্তান’ পেয়ে হারানোর বেদনা
গুলিবিদ্ধ আবদুর রশিদ (২৫) যখন হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তখন জানতে পারলেন তাঁর স্ত্রী ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আনন্দে রশিদের চোখে পানি চলে এল। মুহূর্তেই মনে পড়ল নিজের দারিদ্র্যের কথা। যেখানে ঠিকমতো চিকিৎসাই করাতে পারছেন না, সেখানে সংসারের নতুন অতিথির ভরণপোষণ কীভাবে চালাবেন, সেই দুশ্চিন্তা গ্রাস করে রশিদ ও তাঁর স্ত্রী রতনা বেগমকে। তখন তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান দূরসম্পর্কের আত্মীয় তাজুল ইসলাম ও মিনা দম্পতি। এর পরের এক মাসে এই চারজনের জীবনে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা।
আবদুর রশিদের বাড়ি দিনাজপুর সদর উপজেলার কাটাপাড়া গ্রামে। পেশায় তিনি ট্রাক্টরশ্রমিক। নিজ বাড়ি পঞ্চগড়ের ভজনপুর হলেও থাকেন দিনাজপুরের কাটাপাড়া গ্রামে লতিফ ঠিকাদারের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। আড়াই বছর বয়সী তাঁর আরেকটি মেয়ে আছে। স্ত্রী রতনা রশিদের মামাতো বোন ছিলেন।
আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, গত ৪ আগস্ট সকালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে দিনাজপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চেকআপ করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরবেন, এমন সময় হাসপাতাল চত্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ছোটাছুটি, পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলির শব্দ। স্ত্রীকে রেখে পানি আনতে নিচে নামেন রশিদ। এ সময় তলপেটে, ঊরুতে ও নিম্নাঙ্গে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এরপর ওই হাসপাতালেই প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। হামলা-মামলার ভয়ে ওই দিন সন্ধ্যার আগেই স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি চলে আসেন রশিদ।
৭ আগস্ট ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গেলে সার্জারি বিশেষজ্ঞ রশিদকে এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলেন। সেখানে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ৯ আগস্ট মেয়ের বাবা হন তিনি।
রশিদের চিকিৎসা ও নবজাতকের ভরণপোষণ নিয়ে যখন রশিদ-রতনা দম্পতি দুশ্চিন্তায় পড়লে এগিয়ে আসেন তাজুল-মিনা দম্পতি। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। পারিবারিক অসচ্ছলতা ও রশিদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নবজাতককে লালন-পালনের আগ্রহ প্রকাশ করেন তাঁরা। রশিদ-রতনাও তাতে সায় দেন। জন্মের তিন দিন পর ১২ আগস্ট শিশুটিকে নিয়ে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ক্লিনিক পাড়ায় নিজ বাড়িতে যান তাজুল ও মিনা।
নবজাতককে বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা করাচ্ছেন স্ত্রী, গতকাল সোমবার এলাকায় এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন রশিদ ও রতনা। বিষয়টি নজরে আসে দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল আহমেদের। পরে গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কয়েকজন শিক্ষার্থী, সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শিশুটিকে ফেরত আনতে মাইক্রোবাসে রওনা দেন কুড়িগ্রামের ক্লিনিক পাড়া গ্রামে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে নবজাতককে জন্মদাতা মা-বাবার কোলে তুলে দেওয়া হয়।
আবদুর রশিদ বলেন, ‘সন্তান বিক্রি করিনি। নিজের অভাব–অনটন ছিল। আমিও অসুস্থ। স্ত্রী আমাকে দেখবে, নাকি বাচ্চা সামলাবে। তাই লালন–পালনের জন্য সন্তানকে ওই আত্মীয়ের কাছে দিয়েছিলাম। তবে তাঁরা আমার চিকিৎসার জন্য ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিল।’
শিশুটিকে দত্তক নেওয়া তাজুল ইসলাম পেশায় একজন মুদিদোকানদার। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমাদের কোনো সন্তান নেই। বাচ্চাটাকে লালন–পালনের আগ্রহ দেখালে তাঁরা নিজেরাই আমাদের হাতে তুলে দেন। এখানে বাচ্চা কেনাবেচার কোনো ঘটনা নেই। বরং নিজে থেকেই ২৫ হাজার টাকা রশিদের চিকিৎসার জন্য দিয়েছি। ২৯ দিন বাচ্চাটাকে লালন–পালন করেছেন আমার স্ত্রী। আকিকা করে বাচ্চার নামও রেখেছি তানহা বেগম। এই কয়েক দিন বাড়িটা আনন্দে ভরপুর ছিল। এতটুকুও অবহেলা হতে দিইনি। আজ বাচ্চাটাকে নিয়ে যাওয়ার পরে আমার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। স্যালাইন লাগাতে হয়েছে শেষমেশ।’
সোমবার রাতে নবজাতককে ফিরে পেয়ে রশিদের স্ত্রী রতনা বেগম বলেন, ‘অভাব–অনটনের কথা ভেবে বাচ্চাকে আত্মীয়ের কাছে দিয়েছিলাম। পরে খুব খারাপ লাগছে। বাচ্চাকে ফিরে পেয়ে এখন ভালো লাগছে। তবে বাচ্চার যত্ন নিয়েছে ওরা।’
বর্তমানে বাসাতেই আছেন রশিদ। তাঁর শরীরের অবস্থা ভালো না। এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মাহাবুব মোর্শেদ জানান, রশিদের শরীরে আরও গুলি আছে। প্রস্রাবের জন্য ড্রেন করে দেওয়া হয়েছে নাভি দিয়ে। এখন পর্যন্ত তাঁর চিকিৎসার যাবতীয় খরচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকেও আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখা হচ্ছে তাঁর।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ বলেন, রশিদের যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয় সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে বহন করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রশাসন কর্তৃক নগদ ৪০ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে।