নরসিংদী কারাগার যেন ধ্বংসস্তূপ

ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কারাগার কবে নাগাদ বন্দীদের রাখার উপযোগী হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কারা কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার বিকেলেছবি: প্রথম আলো

নরসিংদী জেলা কারাগারের বন্দীদের থাকার জায়গা, রান্নাঘর, কনডেমড সেল ও অফিস এখন আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই। সবখানে পোড়া চিহ্ন, লন্ডভন্ড অবস্থা। দেখে মনে হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো ধ্বংসস্তূপ। গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কারাগারে ঢুকে এমন চিত্র চোখে পড়ে।

গত শুক্রবার বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এ সময় কারাগারে থাকা ৮২৬ জন বন্দী পালিয়ে যান।

শুক্রবারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একাধিক কারারক্ষী ও স্থানীয় কয়েকজন বলেন, বিকেল সোয়া চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে নরসিংদী জেলা কারাগারের দুই দিকের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। এ সময় পেট্রলবোমা মারা হয়। কারাগারের ভেতরে নানা জায়গায় আগুন ধরে যায়। আন্দোলনকারীরা ছিনিয়ে নেওয়া চাবি দিয়ে বন্দীদের বেশ কটি কক্ষের তালা খুলে দেন। কিছু কক্ষের তালা ভেঙে ফেলা হয়। চারপাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। এ সময় আন্দোলনকারীরা আসামি ছিনিয়ে নেন।

হামলা–অগ্নিসংযোগের পর নরসিংদী কারাগার যেন ধ্বংসস্তূপ। মঙ্গলবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, কারাগারে যাঁরা হামলা করেছেন, তাঁদের হাতে লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাঁদের হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন কারারক্ষীরা। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারারক্ষীরা নিরাপদ অবস্থানে চলে যান।

শনিবার কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাদাপোশাকে আছেন। কারাগারের অফিস, রান্নাঘর, বন্দীদের থাকার জায়গা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের থাকার কনডেমড সেলসহ পুরো এলাকায় আগুনে পোড়ার দাগ। আশপাশের উৎসাহী লোকজন কারাগারের ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। কেউ কেউ কারাগারের বাগানের ফুল-ফল ছিঁড়ে বাড়ি নিয়ে গেছেন।

বন্দীদের কারাগার থেকে চলে যাওয়ার সময়ের কথা উল্লেখ করে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বের হয়ে যাওয়ার সময় বন্দীদের অনেকে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এক বন্দী তাঁকে বলেছেন, তাঁর ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তিনি ১০ বছর সাজা খেটেছেন। তিনি এখন সুযোগ পেয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন।

ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কারাগার পরিদর্শনে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারারক্ষী বলেন, কারারক্ষীরা হামলাকারীদের বাধা দিলে তাঁদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মারধর করে তাঁদের কাছ থেকে চাবি ছিনিয়ে নেন হামলাকারীরা। চাবি নিয়ে তাঁরা বন্দীদের থাকার জায়গায় যান। সেখানকার প্রতিটি জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেন।

শনিবার কারাগারের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বন্দীদের কক্ষের কোনো কোনো তালা ভাঙা, কিছু তালা চাবি দিয়ে খোলা অবস্থায় ছিল। সবার সব জিনিস পুড়ে গেছে। সেসব পোড়া জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

কারা সূত্র বলছে, আন্দোলনকারী ও বন্দীরা মিলে অস্ত্রাগারের চাবি ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাঁরা ৮৫টি অস্ত্র ছিনিয়ে নেন। এ ছাড়া চায়নিজ রাইফেলের ৭ হাজার গুলি ও শটগানের ১ হাজার ৫০টি গুলি ছিনিয়ে নিয়েছেন।

আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন কয়েকজন বন্দী। মঙ্গলবার বিকেলে কারাগারের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদী কারাগারের জেলার কামরুল ইসলাম (পরে সাময়িক বরখাস্ত) প্রথম আলোকে বলেন, মূলত বন্দীদের ছিনিয়ে নেওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল্যবান সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। কারাগারের কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দীদের কাছে থাকা ১০-১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। গত ১৪০ বছরের ইতিহাসে আসামি বিদ্রোহের ঘটনা থাকলেও বাইরে থেকে এসে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এ কারাগারে ৭৫ জন কারারক্ষী আছেন, যাঁদের ২০ জন আহত হয়েছেন। রাফি নামের এক কারারক্ষীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।

কারাগারের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মঙ্গলবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

কারা সূত্র বলছে, পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ বন্দীর ৫ জন গতকাল সকালে কারাগারের সামনে আসেন। তাঁরা বন্দী হিসেবে তাঁদের নেওয়ার কথা বলেন। তখন কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, তাঁদের কারাগারে রাখার মতো অবস্থা নেই। তাঁদের অপেক্ষা করতে বলা হয়।
নরসিংদী জেলা গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খোকন চন্দ্র সরকার বলেন, কারাগার থেকে অস্ত্র লুটের অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারাগারের আশপাশ এলাকা থেকে তাঁদের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়।