কুমিল্লায় ‘মর্যাদার লড়াইয়ে’ ভোটের মাঠে মুখোমুখি মন্ত্রী-এমপির স্বজন-ঘনিষ্ঠরা
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ ও বরুড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে আগামীকাল মঙ্গলবার। দ্বিতীয় ধাপের এই নির্বাচকে উভয় উপজেলার ভোটাররা ‘মর্যাদার লড়াই’ হিসেবে দেখছেন। একদিকে আছেন বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রীর আত্মীয় ও সাবেক এক মন্ত্রীর ভাই। আরেক দিকে ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতা। তাঁদের পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছেন সংসদ সদস্যরাও।
কুমিল্লার রাজনৈতিক অঙ্গনের সবার চোখ এখন এই দুই উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের দিকে। দুই উপজেলায় সব চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ফলে লড়াইটা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগেরই।
সদর দক্ষিণে লড়াই হবে সারোয়ার-বাবলুর
সদর দক্ষিণ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনজন। তাঁরা হলেন সদর দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টানা তিনবারের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার, কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও টানা তিনবারের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাবলু এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান রিপন। নির্বাচনে গোলাম সারওয়ার কাপ-পিরিচ, আবদুল হাই হেলিকপ্টার, আক্তারুজ্জামান আনারস প্রতীক নিয়ে ভোট করছেন।
গোলাম সারওয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী, কুমিল্লা-১০ (সদর দক্ষিণ, লালমাই ও নাঙ্গলকোট) আসনের সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই। সারওয়ারের পক্ষে সাবেক অর্থমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা আছেন।
আবদুল হাই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও সেনানিবাস এলাকা) আসনের সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দীন। বাহাউদ্দীনের অনুসারী নেতারা সদর দক্ষিণ উপজেলায় গিয়ে আবদুল হাইয়ের পক্ষে সরাসরি প্রচারণা, সভা ও সমাবেশে অংশ নিয়েছেন।
চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল হাই বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে রাজনীতি করছি। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে শুরু আমার। রাজপথের পরীক্ষিত কর্মী আমি। এই এলাকার মানুষ পরিবর্তন চায়, উন্নয়ন চায়। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সহযোদ্ধা, অগ্রজ, কর্মীরা আমার পক্ষে মাঠে নেমেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনে আমি জিতব। বাহাউদ্দীনের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি আমার পক্ষে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। প্রতিপক্ষ তো তাঁর ভাইয়ের ওপর ভর করে জিততে চান।’
চেয়ারম্যান প্রার্থী গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘কুমিল্লা মহানগরের লোকজন সদর দক্ষিণে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন প্রত্যক্ষভাবে একজনকে সমর্থন দিয়ে তাঁর কর্মীদের মাঠে নামিয়েছেন। ভোটের দিন বহিরাগতমুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ চাই।’
বরুড়ায় একজন নিষ্ক্রিয়, মুখোমুখি দুই প্রার্থী
বরুড়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনজন। তাঁরা হলেন হেলিকপ্টার প্রতীকের প্রার্থী এ এন এম মইনুল ইসলাম, আনারস প্রতীকের প্রার্থী হামিদ লতিফ ভূঁইয়া ওরফে কামাল ও মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ওরফে লিংকন।
মইনুল ইসলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। তিনি কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) আসনের চারবারের সংসদ সদস্য প্রয়াত আবদুল হাকিমের ছেলে। মইনুলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও তাঁর পক্ষে নেই। তবে বরুড়া পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বকতার হোসেন ও জেলা পরিষদের সদস্য জসিম উদ্দিন তাঁর পক্ষে মাঠে নেমেছেন।
প্রার্থী হামিদ লতিফ ভূঁইয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রীর ভাই। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। তাঁর পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন শামীমের সমর্থন আছে। কামালের পক্ষে ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন চেয়ারম্যান মাঠে তৎপর। বিএনপির নেতা-কর্মীরাও তাঁর পক্ষে।
প্রার্থী নাসির উদ্দিন বরুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকেই নিষ্ক্রিয়। নির্বাচনী মাঠে তিনি নেই।
চেয়ারম্যান প্রার্থী এ এন এম মইনুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ দিয়ে আনারস প্রতীকের প্রার্থী আমার নেতা-কর্মীদের হয়রানি করছেন। আমাকে আটকানোর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি ও কৌশল নিয়েছেন। সুষ্ঠু ভোট হলে হেলিকপ্টার জিতবে।’
হামিদ লতিফ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি কাউকে হয়রানি করছি না। কারও নাম ব্যবহার করছি না। বরুড়ার মানুষ পরিবর্তন চায়। পরিবর্তনের জন্য আমাকে ভোট দেবেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের নাম আমি কোনো ধরনের প্রচারণায় ব্যবহার করছি না।’
নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগ কাউকে সমর্থন দেয়নি বা প্রার্থিতাও ঘোষণা করেনি মন্তব্য করে বরুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দুইবারের সাবেক সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘যে যাঁকে পছন্দ করেন, তাঁকে ভোট দেবেন। তাঁর পক্ষে নেতা-কর্মীরা কাজ করছেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহসানুল কবীর বলেন, এই দুই উপজেলায় মর্যাদার লড়াই হবে। সাবেক দুই ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে সরকারের বর্তমান ও সাবেক দুই মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভোটযুদ্ধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংসদ সদস্য ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের পছন্দ–অপছন্দের ব্যাপারও। এ জন্য ২১ মে সবার চোখ থাকবে এখানে।