সাড়ে ৪ মাসে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ৩০ ঘটনা রাউজানে

গুলিপ্রতীকী ছবি

মামলা, হামলার শিকার হয়ে গত আওয়ামী সরকারের ১৬ বছর এলাকায় যেতে পারেননি রাউজান উপজেলা বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী। জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর এলাকায় ফিরতে শুরু করেন তাঁরা। কিন্তু এলাকায় ফিরেই নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা।

চাঁদাবাজি, বালুমহাল দখল ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ৫ আগস্টের পর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে সংঘর্ষ, হামলা ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৩০টি। এর মধ্যে ২২টিই ঘটেছে উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে।

এলাকাবাসী জানান, ওই এলাকায় প্রতি রাতেই গোলাগুলি হচ্ছে। আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না রাউজানবাসীর। অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, রাউজানে জেলা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স পাঠানো হয়েছে। অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাসে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।

হানাহানিতে লিপ্ত দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তবে দুজনেরই দাবি, তাঁরা সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন।

গিয়াসের অনুসারী হিসেবে রয়েছেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য জসিম ওরফে দুবাই জসিম, আবদুর রশিদ, কামাল উদ্দিন, মো. হাবিব, লোকমান, হোসেনসহ ২৫ থেকে ৩০ জন। গোলাম আকবরের অনুসারী হিসেবে রয়েছেন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ফজল হক, তাঁর ভাই উত্তর জেলা যুবদলের যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক জানে আলম, মো. মামুন, মো. তৈয়ব, নঈম উদ্দিন, মানিকসহ ৩০ থেকে ৩৫ জন। এর মধ্যে ২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হন জানে আলম।

স্বাধীনতার পর থেকে রাউজান সন্ত্রাসের জনপথ হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী সরকারের ১৬ বছর সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর কথাই ছিল রাউজানের আইন। তাঁর ভয়ে কেউ টু-শব্দ করতে পারতেন না। ফজলে করিমের মতের বিরোধী হলেই তাঁকে এলাকাছাড়া করা হতো। বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও আধ্যাত্মিক সংগঠন মুনিরীয়া যুব তবলিগের সমর্থকেরাও হামলা, নির্যাতন ও এলাকাছাড়া ছিলেন। গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন ফজলে করিম।

এবার ঘটনার শুরু গত ১৮ আগস্ট। ওই দিন উপজেলার চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের জিয়া বাজারে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা মিছিল বের করলে হামলার শিকার হন। জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক ছোটন আজম প্রথম আলোকে বলেন, গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারীরা লাঠিসোঁটা ও হকিস্টিক নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করেন। দুদিন পর নোয়াপাড়ার পথেরহাট বাজারে গিয়াস উদ্দিনের অনুসারীরা পথসভা করেন। সভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাঁদের ওপর হামলা হয়।

এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর নোয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় থেকে গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারী উপজেলার দুই ছাত্রদল নেতা জয়নাল আবেদীন ও মুহাম্মদ সাজ্জাদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মারধর করে হাত-পা বেঁধে নদীর চরে মৃত ভেবে তাঁদের ফেলে রেখে যান হামলাকারীরা।

সেদিনের ঘটনার পর থেকে ভয়ে এলাকাছাড়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হামলা, মামলার শিকার হয়ে এলাকায় যেতে পারেননি। আর এখন গিয়াস কাদেরের অনুসারীদের কারণে তিনি এলাকাছাড়া। এ ঘটনায় জয়নালের বাবা শওকত আলী বাদী হয়ে রাউজান থানায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।

১২ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিমকে গ্রেপ্তার করা হলে পথেরহাট বাজারে আনন্দমিছিল বের করেন গিয়াস উদ্দিনের অনুসারীরা। ওই মিছিলে হামলায় উপজেলা যুবদলের নেতা সুজন আচার্যসহ ১০ থেকে ১২ জন আহত হন। এই ঘটনার জন্য আকবরের অনুসারীদের দায়ী করে মামলা হয়েছে।

সাড়ে চার মাসে সংঘর্ষ, হামলা ও গোলাগুলির অন্তত ৩০টি ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৫টি। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৪ জন।

অস্ত্র প্রদর্শনের ভিডিও

রাউজানের নোয়াপাড়ায় অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। দুটি ভিডিওতে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক জানে আলম ও তাঁর সহযোগীদের দেখা গেছে। ১০ অক্টোবর নোয়াপাড়ার খায়েছ আহমদ চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনের ভিডিওতে দেখা যায়, কামাল উদ্দিনের ঘরের সামনে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে তাক করতে উদ্যত হন জানে আলম।

এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর কামালের বাড়ির গেটের সামনের রাস্তায় দোনালা বন্দুকসহ দেখা যায় জানে আলম ও তাঁর কয়েকজন সহযোগীকে। পরে যৌথ বাহিনী ২ ডিসেম্বর নগরের চেরাগী পাহাড় মোড় থেকে জানে আলমকে গ্রেপ্তার করে।

রেহাই পাচ্ছেন না নিরীহ গ্রামবাসী

গুলি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নিরীহ গ্রামবাসীও। গত ১৪ নভেম্বর রাতে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের নিরামিশপাড়া গ্রামের আসদ আলী মাতব্বরপাড়া মসজিদ এলাকায় গুলিতে আহত হন ১৫ গ্রামবাসী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াপাড়া থেকে ঘরে ফিরছিলেন তাঁর ভাই মো. মহিউদ্দিন। আসদ আলী মাতব্বরপাড়া মসজিদ এলাকায় তাঁর ভাইকে কে বা কারা মারধর করেন। গ্রামের লোকজন খবর পেয়ে বেরিয়ে এলে মুখোশধারী ১৫–২০ জনের দল এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। এতে গুলিবিদ্ধ হন নিরীহ ১৫ গ্রামবাসী।

নিরামিশপাড়া থেকে আরও দুই কিলোমিটার দক্ষিণে শেখ পাড়া। ১৭ ডিসেম্বর শেখ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়–সংলগ্ন এলাকার মো. ইসমাইল বলেন, রাত হলেই গোলাগুলির শব্দ। তাঁরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। জানতে চাইলে রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম শফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

পরস্পরকে দুষছেন দুই নেতা

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাউজানে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয়ে রয়েছেন। তাঁরাই বিএনপির অনেক সভা-সমাবেশে হামলা করেছেন। তিনি কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দেন না বলে দাবি করেন।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, হামলার পেছনে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া দলের প্রতিপক্ষ দায়ী। তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করেন বলে দাবি করেন।

দলে কিংবা দলের নাম ভাঙিয়ে কারও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ নেই বলে জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান। তিনি বলেন, রাউজানের বিষয়ে যখনই কেন্দ্রের নজরে এসে তখনই ব্যবস্থা নিয়েছে।