জীবনে বহু কিছু করার পর ‘ধৈর্য-সহ্যে’ কপাল খুলছে গোলাম রসুলের
সবে সন্ধ্যা নেমেছে শহরের বুকে। খুলনা নগরের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতে ছোট একটা দোকানের সামনে বেশ ভিড়। অর্ডার দিয়ে কেউ টুলে বসে আছেন, কেউ আবার প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। বিক্রেতা দুজনের চার হাত যেন চলছে সমানতালে। একজন ছোট ছোট ফুচকা বানাচ্ছেন, তো আরেকজন ভেলপুরির প্লেট সাজাচ্ছেন। আবার কখনো একজন পেঁয়াজ–শসা কুচি করে নিচ্ছেন আর আরেকজন বিল রাখা বা টিস্যু এগিয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত।
নগরের আহসান আহমেদ রোডের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের একটি ছোট ফুচকা ও ভেলপুরির ভ্রাম্যমাণ দোকানের চিত্র এটি। দোকানের নামটাও বেশ অন্য রকম। ‘ধৈর্য-সহ্য ছোট ফুচকা ও ভেলপুরি স্টোর’। দোকানটি চালান গোলাম রসুল নামের একজন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলে এই ভ্রাম্যমাণ দোকান। এই দোকানের ছোট ফুচকা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
গোলাম রসুলের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের পুরাতন ঘোষগাতী গ্রামে। সাত ভাই–বোনের সংসারে রসুলের বড় ভাই ভাজাপোড়া খাবারের ব্যবসা করতেন। বুঝতে শেখার পর থেকেই তাই এতেই হাতেখড়ি হয় রসুলের। তবে তাতে ঠিক পোষাচ্ছিল না। তাই বছর ৩০ আগে কিছু করার আশায় খুলনা শহরে আসেন গোলাম রসুল। তবে এই শহরে পুরোপুরি থিতু হতে পারেননি। নানা টানাপোড়েনে কখনো খুলনা, কখনো মোল্লাহাট, আবার কখনো ঢাকায় কেটেছে তাঁর সময়। ৪৮ বছরের এই জীবনে নানা রকম কাজ করেছেন। ব্যবসাও করেছেন অনেক কিছুর। তবে সেসব ব্যবসায় কেবল লোকসানই হয়েছে তাঁর। অবশেষে ‘ছোট ফুচকায়’ তাঁর কপাল খুলেছে।
কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই কথা হয় গোলাম রসুলের সঙ্গে। রসুল বলেন, ‘আগে রিকশা চালাইছি। নানা রকম ব্যবসাও করছি। গ্রাম থেকে কিনে মাওয়া ফেরিঘাট আর ঢাকায় ডাব বেচছি। ওই ব্যবসায় অনেক মার খাইছি। মানুষ টাকা দেয় নাই। এখনো ৬০-৭০ হাজার টাকা পাব। ডাব ব্যবসায় মার খেয়ে দুই বছর আগে আবারও খুলনা শহরে আসি কিছু করা যায় কী না সেই জন্যি।’ খুলনা এসে আবারও রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে থাকেন রসুল একই সঙ্গে মাথায় ঘুরতে থাকে চিন্তা। এরপর শীতের পিঠা বিক্রি শুরু করেন। শীত শেষ হতে আবারও অনিশ্চয়তা। এখন কী হবে!
গোলাম রসুল বলেন, ‘গরম চলে আসল, কী করব বুঝে পাচ্ছিলাম না। পরে খুলনার ৭ নম্বর ঘাট থেকে কিনে ভেলপুরি বেচছি। কিন্তু এতে হচ্ছিল না। এরপর চিন্তা করলাম আনকমন কিছু করা যায় কি না। গত বছরের কোরবানির ঈদের পর থেকে শুরু করি ছোট ফুচকা বিক্রি।’
ঢাকার জুরাইন থেকে ছোট ছোট ফুচকাগুলো কিনে আনেন রসুল। ফুচকার ভেতরের পুরসহ অন্য সবকিছুর রেসিপি তাঁর নিজের। টক-ঝাল-আর মিষ্টি সসের পানিতে ডোবানো ছোট ছোট আকারের ফুচকা অল্প দিনেই জনপ্রিয়তা পায়। খুলনার মানুষের কাছে অনেকটা নতুন ধরনের এই ফুচকায় আগ্রহ তৈরি হয়। দিন দিন ভিড় বাড়তে থাকে গোলাম রসুলের ফুচকার দোকানে। খুলনার আহসান আহমেদ রোডে বেশ কয়েকটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অসংখ্য কোচিং সেন্টার আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আর অভিভাবকেরাই মূলত এর ক্রেতা। বাইরে থেকেও অনেকে আসেন এই ফুচকা খেতে।
দোকানে ফুচকা খেতে আসা পল্লবী রায় বলেন, ‘এই ফুচকার মজাই আলাদা। স্বাদ ও পরিবেশনাও ব্যতিক্রমী। সুযোগ পাইলেই এখানে চলে আসি।’
ছোট এই ফুচকার বিশেষ দিক কী, জানতে চাইলে রসুল বলেন, ‘ফুচকা মানে তো টক ঝাল। আমার ফুচকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিষ্টি-টক-ঝাল। খুলনায় টক-ঝাল–মিষ্টিতে ভেজানো ফুচকার চল ছিল না।’
দোকানের নামের বিষয়ে গোলাম রসুল বলেন, তিনি ব্যতিক্রমধর্মী কিছু করতে চান, তাই এ রকম একটা নাম দিয়েছেন। তাঁর অধীনে এখন চারজন কর্মী ফুচকা তৈরি ও বিক্রির কাজ করেন। বেচাবিক্রি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানেই ৪০০ থেকে ৪৫০ পিস বিক্রি হয়। বেশ কিছু পার্সেলও যায়। কর্মীদের পেছনে খরচ, দোকান খরচ, ফুচকার অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৩৫-৪০ হাজার টাকা পকেটে থাকে।’
জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়াচ্ছেন গোলাম রসুল। চলতি সপ্তাহেই সরকারি করোনেশন স্কুলের পাশে একটা স্থায়ী দোকান নিয়েছেন। সেখানে সকাল ১০টা থেকে বেচাকেনা শুরু হবে। সঙ্গে ফুটপাতে বিক্রিও চলবে।