কক্সবাজারে গিয়ে শুঁটকি কিনবেন, কীভাবে চিনবেন কোনটি বিষমুক্ত
কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোন ও সৈকত এলাকায় সারি সারি শুঁটকির দোকানে সব সময় লেগে থাকে ক্রেতাদের ভিড়। পর্যটকেরা অনেক সময় না জেনেই তড়িঘড়ি করে রাসায়নিক দেওয়া শুঁটকি কিনে প্রতারিত হন। আবার দেশি শুঁটকি ভেবে অনেকে কেনেন বাইরে থেকে আমদানি করা ভেজাল ও নিম্নমানের শুঁটকি। তবে দরিয়া নগরেরই কয়েকটি স্থানে তৈরি হচ্ছে বিষমুক্ত শুঁটকি। সেখানে গিয়ে দেখেশুনে কিনলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, আবার মিলবে ভেজালমুক্ত খাঁটি শুঁটকি।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের পূর্ব পাশে বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা নতুন ফিশারিপাড়ায় তৈরি হচ্ছে বিষমুক্ত শুঁটকি। এখানকার প্রতিটি বসতবাড়ির ছাদে ও চালে বাঁশের মাচাংয়ে করে শুঁটকি তৈরি হয়। উন্মুক্ত পরিবেশে লোনা হাওয়ায় মাছ শুকানো হয়। প্রয়োগ করা হয় না কোনো রাসায়নিক। মৎস্য বিভাগ থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে, এখানকার শুঁটকি বিষমুক্ত। তবে রোদে ও হাওয়ায় শুকানো শুঁটকির উৎপাদন খরচ বেশি বলে এখানকার শুঁটকির দামও একটু বেশি।
ফিশারিপাড়ায় শুঁটকি কিনতে গিয়ে পর্যটকেরা অনেকেই এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করেন। প্রথমত, নিরাপদ শুঁটকি তো পাওয়াই গেল। দ্বিতীয়ত, শুঁটকি তৈরির সামগ্রিক চিত্রটাও দেখা হয়ে যায় এখানে এলে। যাঁরা তীব্র ঘ্রাণের সঙ্গে সমঝোতা করে পাড়া ঘুরতে পারবেন, তাঁদের জন্য দেখার অনেক কিছুই আছে এখানে। পাড়ার প্রায় প্রতিটি বাড়ির মাচাংয়ে ঝুলতে দেখা যাবে রুপচাঁদা, সুরমা, গুইজ্যা, ছুরি, কামিলা, চাপা, পোপা, মাইট্যা, শোল, রাঙাচকি ও লাক্ষা মাছ। আছে দুই থেকে পাঁচ কেজি ওজনের শুঁটকিও। এসবের মধ্যে সবচেয়ে দামি লাক্ষা শুঁটকি। ৫ কেজি ওজনের একটি লাক্ষা শুঁটকির দাম কমপক্ষে ১৪ হাজার টাকা।
পাড়ারই একটি মহালের মালিক মো. মফিজ (৩২) প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন আগে ফিশারীঘাট থেকে তিনি ১৭ কেজি ওজনের একটি লাক্ষা মাছ কিনেছিলেন। শুকানোর পর এটির ওজন হয়েছে পাঁচ কেজি। এই লাক্ষা শুঁটকি পাইকারিতে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হবে। আর খুচরায় নিয়ে গেলে দাম পড়বে ১৫-১৭ হাজার টাকা।
পাড়ায় পাইকারি দোকানের পাশাপাশি বেশ কিছু খুচরা দোকানও রয়েছে। তেমন একটি দোকানে গিয়ে জানা গেল কোন শুঁটকির কত দাম। এখানকার বিভিন্ন দোকানে রুপচাঁদা ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার, সুরমা ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০, গুইজ্যা ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, ছুরি-১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, পোপা ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ তো গেল দামের বিষয়। এবার শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. মফিজের কাছে প্রশ্ন, কী করে চেনা যাবে কোনটি বিষমুক্ত ও ভালো মানের শুঁটকি? তিনি জানান, খাঁটি ও ভালো মানের বিষমুক্ত শুঁটকি হবে শক্ত, চাপ দিলে ভাঙবে না। চকচক করবে না। আর শুঁটকির ওপরে সাদা কোনো গুঁড়ার আস্তর থাকবে না। স্বাভাবিক গন্ধ থাকবে প্রতিটি শুঁটকিতে।
তবে কেবল ফিশারিপাড়া নয়, শহরের নাজিরার টেকেও তৈরি হচ্ছে এমন বিষমুক্ত শুঁটকি। পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরাটেক উপকূলে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম পড়েছে এখন। এখানে শুঁটকি উৎপাদনের মহাল রয়েছে প্রায় ৮০০টি। মহালগুলোতে দৈনিক ১২০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে। বেশির ভাগ লইট্যা, ছুরি, পোপা, মাইট্যা, কামিলা, ফাইস্যা, রুপচান্দা ইত্যাদি।
কক্সবাজার শুঁটকি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইসহাক প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ফিশারিপাড়ায় বর্তমানে ২৭টি মাচাংয়ে বড় শুঁটকির উৎপাদন চলছে। আগামী মে পর্যন্ত ৬ মাসে অন্তত ৭০ কোটি টাকার ২০০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন করা হবে। বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে কি না, সরেজমিন তদারকির ব্যবস্থাও রাখা আছে। কোস্ট ফাউন্ডেশন বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে উৎসাহিত করতে ব্যবসায়ীদের বাঁশের মাচাং নির্মাণ করে দেওয়ার পাশাপাশি ২ কোটি টাকার বেশি অর্থসহায়তা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্ট ফাউন্ডেশনের কক্সবাজার শুঁটকি প্রকল্প ব্যবস্থাপক তানজিরা খাতুন বলেন, বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। গত সাত বছরে কয়েক হাজার উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন করা হয়েছে। সহজ শর্তে পল্লী কর্মী–সহায়ক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, নতুন ফিশারিপাড়া ও নাজিরারটেক উপকূলে এখন বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে পর্যটকের চাপ বেড়ে গেলে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে আমদানি করা শুঁটকি নিয়ে এসে বেচাবিক্রি করেন। এসব শুঁটকিতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষ কিংবা কীটনাশক মেশানো থাকে।