‘মুক্তপ্রদীপের মতো’ জ্বলে আছে বরুণের ফুল

বরুণগাছে সাধারণত বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে ফুল আসা শুরু হয়ছবি: প্রথম আলো

ভোরের আলো ফুটেছে অনেক আগেই। সেই অর্থে মানুষের জেগে ওঠার সরবতা তখনো ছড়িয়ে পড়েনি। চারপাশে সুনসান স্তব্ধতা গা এলিয়ে আছে। ছিটেফোঁটা দু-চারজন করে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে বের হয়ে আসছেন, পথে হাঁটছেন। মনু নদের পাড়টি আরও নীরব, জনমানবহীন শান্ত একটুকরা নির্মল হাওয়ার ভূমি হয়ে আছে। তখন ‘সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ/ সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে, সেখানে বরুণ...।’

জীবনানন্দ দাশের নাটার রঙের মতো রাঙানো সূর্যের জেগে ওঠার এই মুহূর্তে একফালি মনু নদ কি আর গঙ্গাসাগরের মতো কোনো উপমার সঙ্গে সমান হতে পারে, চলতে পারে! তা না-ই হলো, তবু সেখানে গঙ্গাসাগরের বুকের কাছে যেমন বরুণ থাকে, তেমনই এখানেও এই মনু নদের পাড়ে চুপি চুপি, শাখায় শাখায় ফুলের বন্যা নিয়ে জেগে আছে বরুণের গাছ।

বসন্তের সকাল, মৃদু বাতাসে তখনো কিছুটা ঠান্ডার মতো ভাব আছে। সময় উড়ছে সকালের নরম রোদের পালকে। এ রকম একটা সময়ে পথ চলতে চলতে মৌলভীবাজার শহরের ফরেস্ট অফিস সড়কের ভৈরব থলির কাছে পৌঁছেই দেখা হয়ে যায় তার সাথে, তাহাদের সাথে। ‘বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে!/ ফুটছে ভাষা কেউটে ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে!/ প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে/ বরুণরানি ফিরছে যেথা, মুক্তপ্রদীপ জ্বলে।’ অনেকটা তা–ই, গাছের শাখায় শাখায় সবুজ পাতার ফাঁকে মুক্তপ্রদীপের মতো জ্বলে আছে সাদা, গোলাপি, সবুজের মিশ্রণে অসংখ্য বরুণ ফুল।

ফুলটির পোশাকি নাম বরুণ হলেও আরও অনেক নাম আছে। যেমন: বৈন্যা, শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম।

বছর ঘুরে বরুণ রানির ফেরাটা এ রকমই মনে হয় রাজকীয়, এ রকমই জাঁকজমকের। গাছজুড়ে ফুটে আছে ফুল। দু-চারটা শালিক, ঘুঘু পাখি উড়ে আসছে, ফুলের ওপর বসছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। ফোটা ফুলের পাপড়িরা বাতাসের আহ্লাদে টুকটুক করে ঝরে পড়ছে গাছের নিচে। পাপড়ির নকশিকাঁথা যেন কেউ বিছিয়ে রেখেছে ঘাসের ওপর। বেশ বড়সড় ঝাঁকড়া মাথার গাছ। ডালগুলোও চারদিকে ডানা মেলে আছে। পাশেই মনু নদ। হয়তো কোনো একদিন এই নদের পানিতে ভেসে এসেছিল এই বরুণগাছের ফল। সেই পাকা ফলটি চরের মতো জেগে থাকা পাড়ের মাটিতে আশ্রয় পেয়ে গাছ হয়ে মাথা তুলেছে। তারপর বসন্তের মাঝামাঝি এলেই ডালে ডালে ফুলের জলসা বসছে।

ওখানেই, বরুণগাছটির কাছে এই সাতসকালে দেখা শহরের সৈয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা সাংস্কৃতিক সংগঠক শৈলেন রায়ের সঙ্গে। তিনি জানালেন, গাছটি বেশ অনেক বছর ধরে দেখছেন। তবে গাছে যে এত ফুল ফোটে এবং এই গাছের নাম যে বরুণ, তা আগে সেভাবে খেয়াল করেননি। গাছটির বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর বা এর আশপাশে হতে পারে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, গাছটি এখানে কেউ রোপণ করেননি, গাছটি এমনিতেই গজিয়ে উঠেছে। গাছটি কারও হাতে কাটা পড়েনি বলে এখনো ফুলে ফুলে সাজতে পারছে।

বরুণ গাছের সবচেয়ে পছন্দের আবাসই হচ্ছে জলাভূমি এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

বরুণগাছে সাধারণত বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে ফুল আসা শুরু হয়ে থাকে। তখন ফুলে ফুলে গাছ সেজে ওঠে। মাসজুড়ে ফুলের বন্যা বইতে থাকে গাছে। সাদা-হালকা বেগুনি আঁচযুক্ত ফুল ফোটে। ফুল ঝরে যাওয়ার পরপরই গাছে ফল আসে। ফল দেখতে অনেকটা কতবেলের মতো। বরুণ ফুল জলাভূমির কাছের বাসিন্দা। গাছটির সবচেয়ে পছন্দের আবাসই হচ্ছে জলাভূমি এলাকা। বাংলাদেশের জলাভূমি, নিচু এলাকা, নদীর তীর ও হাওর এলাকায় বরুণের বেশি দেখা মেলে।

মনু নদের পাড়ে এই বরুণগাছটির বেড়ে ওঠাও সেই বার্তাই দিয়েছে। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরের বুক চিরে চলে যাওয়া রাজনগর-বালাগঞ্জ খেয়াঘাট সড়ক দিয়ে আসা-যাওয়ার পথেও বেশ কিছু বরুণগাছের দেখা মিলেছে। ছোট-বড় গাছগুলো কোথাও সড়কের পাশে শরীরভর্তি ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের তালে তালে নাচছে ফুলপরিরা। কোথাও হাওরপারের বাড়ির সীমানার মধ্যে গাছপালার ভিড়ের ভেতর আলাদা হয়ে ভাসছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কেউ আলাদাভাবে গাছগুলো লাগাননি। কেউ এসব গাছের যত্নও করেন না। অন্য সব বুনো গাছের মতো প্রকৃতিতে সামান্য আশ্রয় পেয়ে গাছগুলো একদিন মাথা তুলেছে, তারপর ডালপালা মেলেছে। বসন্ত এলে জানিয়ে দিয়েছে, এখন তাদের ফুলের প্রহর।

ফুলটির পোশাকি নাম বরুণ হলেও আরও অনেক নাম আছে। বৈন্যা, শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম, স্থানভেদে আরও কোনো নাম থাকতে পারে। প্রচলিত ইংরেজি নাম হচ্ছে স্পাইডার ট্রি, টেম্পল প্ল্যান্ট ও গার্লিক পিয়ার। বরুণ ছোট থেকে মাঝারি আকারের একটি বৃক্ষ। বাকল ধূসর-বাদামি ও মসৃণ। সাধারণত ১০ থেকে ২০ মিটার উঁচু হয় গাছ। তবে হাওরপারের কোনো কোনো জনপদে অনেক বড় ও বয়সী বরুণগাছ দেখা যায়।

ফুল ঝরে যাওয়ার পরপরই বরুণ গাছে ফল আসে। ফল দেখতে অনেকটা কতবেলের মতো
ছবি: প্রথম আলো

বরুণ ফুলের মুক্ত পাপড়ি চারটি, পুংকেশর ২০ থেকে ২৫টি, প্রায় ৪ সেন্টিমিটার লম্বা ও বেগুনি হয়ে থাকে। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকার, শক্ত শাঁসালো। বীজ ও শিকড় থেকে চারা হয়। গাছভরা অফুরন্ত ফোটা ফুল, হাওয়ায়-রোদে প্রাণখোলা উচ্ছ্বাসে ভাসে। সাদা ও হালকা হলুদ বর্ণের ফুলের পসরা মাসখানেক ধরে থাকে। বর্ষায় গাছ পানিতে ডুবে গেলেও ভালোভাবেই টিকে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই বরুণ ভেষজ গাছ হিসেবে পরিচিত। পাতা চর্মরোগ, বাত-ব্যথা নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শিকড়ের বাকলের নির্যাস গ্যাস্ট্রিক রোগে ব্যবহার করা হয়। কাঁচা ফল রান্না করে সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। বরুণের আদি আবাস ভারত, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।