লাউয়াছড়ার সীমানা ২৮ বছরেও চিহ্নিত না হওয়ায় বেদখল জমি উদ্ধারে জটিলতা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হলেও এখনো ভূমি জরিপ হয়নি। সীমানা চিহ্নিত না থাকায় ২৮ বছরে উদ্যানের অনেক জমি বেদখল হয়ে গেছে। ভূমি জরিপ না হওয়ায় উদ্যানের জমি কোথায়, কার দখলে কতটুকু আছে, তা নিশ্চিত করতে জটিলতায় পড়েছে বন বিভাগ।
সম্প্রতি বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে। ইতিমধ্যে পৃথক অভিযানে বেদখল হওয়া ছয় একর জমি উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু সীমানা চিহ্নিত না থাকায় উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জ কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাউয়াছড়া বনের পাশে পাবলিক ল্যান্ড (ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি) আছে। বনের ল্যান্ড (জমি) আছে। জরিপ না হওয়ায় সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে জায়গা দখলমুক্ত করা হচ্ছে, সীমানা নির্ধারণ না থাকায় সেখানে খুঁটি মারতেও পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘জরিপ হলে আমরা বুঝতে পারব আমাদের সীমানা কতটুকু। জরিপ হবে বলে শুনেছি।’
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর। ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা এই বন ১৬৭ প্রজাতির গাছ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ৫৯ প্রজাতির সাপসহ ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২২ প্রজাতির উভচরসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল। জীববৈচিত্র্যের টানে দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক উদ্যানে ভিড় করেন।
বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জরিপের মাধ্যমে উদ্যানের সীমানা নির্ধারণ করে ভূমি সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। লাউয়াছড়ার আশপাশে গ্রাম ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি আছে। এ সুযোগে উদ্যানসংলগ্ন কোনো কোনো জমির মালিক বনের জমি দখলে নিয়ে বিভিন্ন মৌসুমি ফলের বাগান করেছেন। অনেকে ঘরবাড়ি করে বসবাস করছেন। বনের ১৫৫ একর জমি নিয়ে বন বিভাগ ও স্থানীয় গ্রামবাসীর মধ্যে মামলাও চলমান।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, সম্প্রতি বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের উদ্যোগে পৃথক দুটি স্থানে অভিযান চালিয়ে ছয় একর বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করা হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের লাউয়াছড়ার বটতলি এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক একর বেদখল জমি উদ্ধার করা হয়। জমশেদ মিয়া নামের এক ব্যক্তির দখলে ছিল ওই জমি। এ ছাড়া ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের দখলে থাকা প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধার করা হয়। জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমিটরি-সংলগ্ন এলাকা থেকে ওই জমি ২০১৮ সালে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আরও অনেক জমি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে আছে বলে ধারণা বন বিভাগের। কিন্তু জরিপ করে সীমানা নির্ধারণ না হওয়ায় তা উদ্ধারে জটিলতায় পড়ছে কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্যানের জমি উদ্ধারে বন বিভাগকে তাগাদা দিচ্ছেন। একাধিক ব্যক্তি লিখেছেন, পাঁচ-ছয় একরই নয়, শতাধিক একর জমি বিভিন্নজনের দখলে আছে। উদ্যানের জমিতে রিসোর্ট আছে। সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দখলমুক্ত করতে হবে এবং যাতে বিতর্ক তৈরি না হয়, সে জন্য যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জমির কখনো জরিপ না হওয়ায় সীমানা নির্ধারণ হয়নি। জরিপের জন্য বিভিন্ন সময় বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় থেকে জরিপ অধিদপ্তরসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জরিপের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জরিপ হলে উদ্যানের প্রকৃত জমি কতটুকু, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, লাউয়াছড়ায় কখনো জরিপ হয়নি। যেগুলো যেভাবে আছে, সেভাবেই আছে। কিছু জমি নিয়ে ‘কনফ্লিক্ট’ (দ্বন্দ্ব) আছে। আবার যাঁদের দখলে আছে, অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কাগজপত্র নেই। উদ্যানের জমি মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরই উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। এখন জরিপটা গুরুত্বপূর্ণ। আগেও জরিপের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আবার চিঠি দেওয়া হবে।