‘এইরহম বন্যা আর দেহি নাই’
ওপারে ভারতের মেঘালয়। পাহাড়ি এলাকা থেকে নামছে ঢল। এতে প্লাবিত ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের প্রায় ১২৭টি গ্রাম। এর মধ্যে মেঘালয়ের শিববাড়ী লাগোয়া দুটি ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় নেমেছে। নেতাই নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে পুরো উপজেলায় প্লাবন চলছে তিনদিন ধরে।
হঠাৎ এ ধরনের বন্যা আসবে, সেই প্রস্তুতি ছিল না মানুষের। পানিবন্দী মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত শুরু হয়নি উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম। সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে উপজেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়নের।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। শুক্রবার দিনভর বৃষ্টি চলে। টানা বর্ষণে উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া, গামারীতলা, ঘোষগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে ও পাহাড়ি ঢলে গ্রাম প্লাবিত হতে শুরু করে। শুক্রবার রাতে ভয়াবহ রূপ নেয়। গ্রামে গ্রামে মানুষ রাত জেগে থাকে। পুরো উপজেলা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ধোবাউড়া সদর বাজারেও পানি প্রবেশ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, স্বাধীনতার পর ১৯৮৮ সালের বন্যাকে সবচেয়ে ভয়াবহ মনে করা হতো। কিন্তু এবারের পানি সব কিছু ছাড়িয়ে। এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি উপজেলাবাসী। ঘরের মধ্যে পানি থাকায় নেই রান্নাবান্না। এতে শুকনা খাবার খেয়ে দিন চলছে। অনেকে খাবারের জন্য হাহাকার করছে। শুক্রবার রাত আটটা থেকেই ঘরের মধ্যে পানি প্রবেশ করে। অনেকে খাটের ওপর বসে রাত কাটিয়েছে, অনেকে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় রাত কাটিয়েছে।
শনিবার দক্ষিণ মাইজপাড়া ও ঘোষগাঁও ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও-ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও-বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে গামারীতলা, ঘোষগাঁও এবং দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের লোকজন। নেতাইপাড়ের অসংখ্য লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন মসজিদ ও স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। অন্তত অর্ধশত বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে।
উপজেলার প্রায় ৩০ শতাংশ ফসল পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে জানিয়েছে ধোবাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার বলেন, পুরো উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদ হয়েছে, শাকসবজি ৪৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। আর মধ্যে ৩০ শতাংশ ফসল পানিতে নিমজ্জিত।
দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের সোহাগীপাড়া গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ মাইন উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় কলসিন্দুর ঘাটপাড় বাজারের কাছে। নিজের জীবদ্দশায় এলাকাতে এত পানি দেখেননি তিনি। বিকেল পাঁচটার দিকে প্রথম আলোকে মাইন উদ্দিন বলেন, ‘বন্যা তো বাবা দেখছি, কিন্তু এইরহম বন্যা আর দেহি নাই। গাংভাঙনে এই পানি বিরাট ক্ষতি করছে। এই রাইতে (শুক্রবার) মাইনসের ঘুম নাই, খাওন নাই অবস্থা গেছে। মানুষের ঘরদর ভাইঙ্গে গেছে গা, ধান-চাউল গেছে গা। নদী না ভাঙলে এই ধরনের পানি হইত না। ইন্ডিয়া থাইক্যা এই পানি আইছে। ইন্ডিয়ার পানি না আইলে এই পানিডাই অয় না। মাইনসের বাড়িঘর তল অইয়া গেছে। মানুষ কই ঘুমাইব, কই খাইব, কই কী করব।’
ধোবাউড়া-কলসিন্দুর সড়কের ধাইরপাড়ায় শনিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে দেখা হয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। শুকনা খাবার ও গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে নৌকার অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের দুজন গামারীতলা ইউনিয়নের দক্ষিণ লাঙ্গলজোড়া গ্রামের বাসন্দিা মাইন উদ্দিন (৪৫) ও আবদুল হোসেন (৫০)। তাঁরা জানালেন, শুক্রবার রাতে হঠাৎ তাঁদের বাড়িতে পানি উঠেন। হাঁটুপানিতে এখন বসবাস। সকালে মুড়ি খেলেও সারা দিন ভাত খাননি। বাড়িতে রান্না করার অবস্থা নেই। তাই গ্যাসের সিলিন্ডার ও চুলা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
গামারীতলা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গোয়ালপাড়া গ্রামের কৃষক আরফান আলী। তাঁর বাড়িতে হাঁটুপানি। নিজের গোয়ালে ১০টি গরু নিয়ে উঠেছেন উপজাতি কালচারাল একাডেমিতে। তাঁর ভাষ্য, গরুগুলো পানির কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য এখানে এনেছেন।
একই এলাকায় পাকা সড়কের পাশে উঁচু ভিটিতে গরুর জন্য তাঁবু করছিলেন কৃষ্ণপুর গোয়ালপাড়া গ্রামের নাজমুল ইসলাম। নিজের পাঁচটি গরু এখানে তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘ফ্যামিলির মানুষ চকির ওপর আছি। গরু রাহনের জায়গা নাই, তাই এইন আনছি।’
মসজিদে আশ্রয়
শনিবার বিকেল সাড়ে চারটা। দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের উত্তর কলসিন্দুর ঘাটপাড় জামে মসজিদের সামনে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি গরু বাঁধা, তিনটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। মসজিদের ভেতর ও বারান্দায় গৃহস্থালির জিনিসপত্র। শুক্রবার রাতে রান্না করেও খাবার খেতে পারেননি মনোয়ারা খাতুন (৪৮)। রান্নার জন্য হাঁড়িপাতিল পরিষ্কার করছিলেন। পাশেই নেতাই নদে ধুতে গিয়ে একটি চামচ পানিতে ভেসে যায়। মনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘শুক্রবার সারা দিন বাঁধে বেডাইন বেইট্টাইন মিইল্লা মাটি কাটেছি। সারা দিন খাইনি। সন্ধ্যার পর রাইন্দা বাইড়া ভাতটি লইতেই চিক্কার ডুক্কার লাগছে। ভাত ফালায়া থইয়া কোনো মতনে উড়ি কোদাল লইয়ে মাডি দেওয়া শুরু করি, কিন্তু মানে নাই। পরে খালি কইছি জিনিস চাইলে যাওক, খালি জান বাঁচাই। মসজিদে আইসা উঠছি। আমার ৩৫ বছরের সাজানো সংসার সব শেষ। জীবনে এমুন বন্যা আর দেখছি না।’
উত্তর কলসিন্দুর গ্রামের আবুল কাশেম (৫২) আট সদস্যের পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নেতাই নদের পাড়ের মসজিদটিতে। উত্তর কলসিন্দুর ঘাটপাড় এলাকায় নেতাই নদের পাড়ে ছিল তাঁর বাড়ি। তিনি ছাড়াও আবদুল মন্নাছ, মাজহারুল ইমলাম, হাবিব মিয়া, কাবিল মিয়া ও মঞ্জুরুলের পরিবারও মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন।
মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িত আমার চাইরটা ঘর আছিন। রাইত সাড়ে আটটার দিকে ভাইঙা গেছে। জিনিসপত্র আনতে পারি নাই। টেকা হাওলাত লইয়া চাউল-ডাইল কিইন্যা আনছি। হঠাৎ কইরা বাঁধ ভাইঙ্গা সব শেষ।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেশি সমস্যা অইছে ড্রেজারের কারণে। নদীর হেই পাড়ে ড্রেজার দিয়া বালু তোলার কারণে এই পাড়ে ভাঙছে। একমাত্র ড্রেজারের কারণে ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে পড়ছি। যাওয়ার মতো পরিবেশ নাই, তাই আপাতত মসজিদে উঠছি। আল্লায় কপালে যা রাখছে, তা–ই অইব।’ আবুল কাশেম আরও বলেন, ‘১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও এমন পানি হয় নাই। এই বন্যা বেশি ভয়াবহ। সে সময় রাস্তা তলাইছিন না। আর এ বন্যায় রাস্তার উপরে পানি।’
উদ্ধার কার্যক্রম নেই
ধোবাউড়া উপজেলা ৭টি ইউনিয়নের ১৬৪টি গ্রামের সব কটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তবে দক্ষিণ মাইজপাড়া ও ঘোষগাঁও ইউনিয়নের অবস্থা বেশি খারাপ। দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের ২৭টি গ্রাম, ঘোষগাঁও ইউনিয়নের ২২টি গ্রামে পানিবন্দী হাজার হাজার মানুষ। এ এলাকায় আগে এত পানি দেখেনি মানুষ। গ্রামগুলোতে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। কোনো নৌকাও নেই এলাকায়। পানিবন্দী থাকলেও বাসিন্দারা সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন বলেন, উপজেলাজুড়েই পানি। তবে দক্ষিণ মাইজপাড়া ও ঘোষগাঁও ইউনিয়নের অবস্থা বেশি খারাপ। সব প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু যারা আক্রান্ত হয়েছে, তারা আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় মেম্বারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি। অনেকে কোমরসমান পানিতে অবস্থান করছে। এমন গ্রামের সংখ্যা অনেক। কিন্তু সেই মানুষেরা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছে না। নেতাই নদের বাঁধের ওপর কিছু গরিব পরিবার ছিল, তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজে অংশ নেবেন।
সরকারি ত্রাণ কার্যাক্রম নেই
শুক্রবার রাতে পানি ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপজেলায়। শনিবার পানিবন্দী মানুষেরা খাবার ও সুপেয় পানির সংকটে পড়ে। সরকারিভাবে ত্রাণ কার্যাক্রম শুরু না হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে শুকনা খাবার বিতরণ করেছেন। তাঁদের একজন অন্তর হাজং। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নেরর কয়েকটি গ্রামে শতাধিক পরিবারকে শুকনা খাবার বিতরণ করেছি।’
দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর সরকার ছোট নৌকা নিয়ে শুকনা খাবার বিতরণে বের হন। ৩০ বস্তা মুড়ি নিয়ে যান জাঙ্গালিয়া পাড়া, সোহাগীপাড়া, পঞ্চনন্দনপুর, খাগগড়া গ্রামে। কিন্তু মুহূর্তেই শেষ সব মুড়ি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মানুষ দুদিন ধরে খাবার পাচ্ছে না। খাবারের জন্য হাহাকার করছে। আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে কিছু শুকনা খাবার দিচ্ছি। আমার পুরো ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী। কিন্তু মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। কষ্ট করে হলেও ভিটাতে অবস্থান করছে। স্বাধীনতার পর দেশে এমন পানি কখনো হয়নি। প্রচুর বৃষ্টি, নদীর পাড় ভেঙে যাওয়া ও পাহাড়ি ঢলে এমন অবস্থা হয়েছে। মেঘালয়ের শিববাড়ী এলাকা থেকে পানি আসছে।’
ধোবাউড়ার ইউএনও নিশাত শারমিন বলেন, বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রমের প্রস্তুতি চলছে। রোববার থেকে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হবে। জেলা থেকে ১০ টন চাল পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবে শুকনা খাবার দিতে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেওয়া হবে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বেগম শাহীন জানান, উপজেলার সব ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৮ হাজার ৫০০ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। শনিবার দুপুরে ধোবাউড়ায় বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পুলিশ সুপার মো. আজিজুর রহমান।