খায়রুলের জঙ্গিবাদে জড়ানোর খবরে হতবাক পরিবার ও এলাকার লোকজন
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় জঙ্গি আস্তানায় গত শনিবারের অভিযানে এক বছর বয়সী সন্তানসহ খায়রুল ইসলাম (২২) ও তাঁর স্ত্রী আটকের ঘটনায় হতবাক তাঁদের পরিবার ও এলাকার লোকজন। ওয়ার্কশপ মেকানিক খায়রুল নামাজি হিসেবে এলাকায় পরিচিত হলেও স্ত্রী-সন্তানসহ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি মেলাতে পারছেন না তাঁরা।
গত শনিবার (১২ আগস্ট) সকালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিসিটিভি) ইউনিট ৬ নারীসহ ১০ জনকে আটক করে। তাঁদের সঙ্গে তিন শিশুও রয়েছে। এই ১৩ জনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের খায়রুল, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের ১২ মাস বয়সী শিশুসন্তান রয়েছে। ওই বাড়ি থেকে জিহাদি বই ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁরা ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বলে জানিয়েছে সিটিটিসি। এ ঘটনার পর সোমবার একই এলাকা থেকে জঙ্গি সন্দেহে আরও ১৭ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয় জনতা।
খায়রুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের মধ্য রসুলপুর এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে। নজরুল ইসলামের তিন সন্তানের মধ্যে খায়রুল বড়। তাঁর ছোট দুই বোন। তিন বছর আগে এক বোনের বিয়ে হয়েছে। সবার ছোট বোনটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। খায়রুল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতা গাউছিয়ায় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। তাঁর বাবা নজরুল ইসলাম অটোরিকশার মেকানিক ছিলেন। ২০১৭ সালে স্ট্রোক করার পর থেকে তিনি শয্যাশায়ী। এ ছাড়া এক বছর আগে পা পিছলে পড়ে নজরুল ইসলামের কোমরের হাড়ও ভেঙে গেছে। সেটি অস্ত্রোপচারে এক লাখ টাকা প্রয়োজন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না তিনি। খায়রুলের মা সানোয়ারা বেগম গৃহপরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান। খায়রুলের জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার খবর শুনে ভেঙে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুতুবপুর ইউনিয়নের মধ্য রসুলপুর এলাকায় খায়রুলদের বাড়িতে দেখা যায়, খায়রুলের বাবা নজরুল ইসলাম বিছানায় বসে আছেন। মা সানোয়ারা বেগম মেঝেতে বসে স্বামীর প্লেটে কাঁঠাল তুলে দিচ্ছেন। পৈতৃক জমিতে দুই কক্ষের টিনশেড ঘরে ছোট মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন খায়রুলের মা–বাবা।
জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে খায়রুলের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাঁর মা সানোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, শ্বশুর সিকিম আলী হাওলাদারের কাছ থেকে মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১১টায় ছেলের আটকের খবর শুনেছেন তাঁরা। তিনি জানান, প্রতি মাসে সংসার চালাতে খায়রুল পাঁচ হাজার টাকা দিতেন। ওই টাকা দিয়ে তাঁদের সংসার চলত ও খায়রুলের বাবার ওষুধ কেনা হতো। ১০ আগস্ট তাঁর টাকা পাঠানোর কথা ছিল; কিন্তু পাঠাননি। অনেক বার চেষ্টা করলেও খায়রুলের মুঠোফোন বন্ধ পান তাঁরা। সানোয়ারা বেগম বলেন, ‘ভেবেছি ছেলের বউয়ের সঙ্গে হয়তো ঝগড়া হয়েছে। এ কারণে ছেলে ফোন বন্ধ করে রেখেছে।’
সানোয়ারা বেগম বলেন, খায়রুল পাগলা উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর বাবা স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হলে পড়াশোনার পাশাপাশি ওয়ার্কশপে কাজ শুরু করেন খায়রুল। কাজের চাপের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। ছোটবেলা থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন খায়রুল। দাড়ি রাখতেন। কাজে যেতেন, কাজ শেষে বাসায় চলে আসতেন। বাসায় থাকলে মুঠোফোন নিয়ে থাকতেন; কিন্তু কোনো আড্ডাবাজি, দলাদলিতে ছিলেন না। জঙ্গিবাদে জড়ানোর মতো কোনো বিষয় তাঁদের চোখে পড়েনি। সন্দেহজনক কোনো লোকজনকেও তাঁরা আসা–যাওয়া করতে দেখেননি। ছেলের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয় কিছুতেই মেলাতে পারছেন না তাঁরা।
সর্বশেষ ১৫ দিন আগে খায়রুল তাঁর মায়ের মুঠোফোনে ফোন করেছিলেন বলে জানান বাবা নজরুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘গাজীপুরে একটি ওয়ার্কশপে ভালো বেতনে কাজ পেয়েছে বলে জানায় ছেলে। ১০ তারিখে সংসার খরচের টাকা পাঠানোর দেওয়ার কথা বলেছিল। ওর ফোন নষ্ট হয়ে গেছে, তাই ফোন বন্ধ থাকবে। এরপর থেকে কোনো যোগাযোগ নেই, ফোনও বন্ধ। নতুন কাজের জায়গার ঠিকানা না থাকায় আমরা খোঁজ নিতে পারিনি।’
নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁর ছেলে অল্প বয়সী, খুব সহজ-সরল। ছেলের জঙ্গিবাদে জড়ানোর বিষয়টি তাঁদের বিশ্বাস হচ্ছে না। কেউ হয়তো তাঁদের ফাঁসিয়ে দিতে পারেন বলে তাঁর ধারণা।
খায়রুলকে গ্রেপ্তার সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা মুদি ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে নামাজি। কোনো ঝামেলায় দেখি নাই। পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। বিষয়টি শুনে অবাক হয়েছি। সঙ্গদোষে এমন হয়েছে কি না, তা–ও জানি না।’ খায়রুল সম্পর্কে একই ধরনের কথা বলেন আরও কয়েকজন প্রতিবেশীও।
আট বছর ধরে খায়রুলদের বাড়িতে ভাড়া থাকেন প্রতিবেশী সোনিয়া আক্তার। তিনি বলেন, মায়ের সঙ্গে ছেলের বউয়ের বনিবনা না হওয়ায় এক বছর আগে বাড়ি ছেড়ে গাউছিয়ায় চলে যান খায়রুল। এক বছরে দুই-তিনবার বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। তিন-চার ঘণ্টা থেকে আবার চলে যেতেন। তিনি এই পথে যেতে পারেন কখনো মনে হয়নি।
ওই এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খায়রুলের দাদা মুদি ব্যবসায়ী। তার বাবা ১০ বছর ধরে অসুস্থ। ছেলেটি ওয়ার্কশপে কাজ করত। তবে তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় ওই ধরনের কোনো অভিযোগ নেই।’
যোগাযোগ করা হলে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আযম প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক খায়রুলের বিরুদ্ধে তাঁর থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি।