খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিক্রির লাভের টাকা বিএনপি সভাপতির পকেটে

দিনাজপুর জেলার মানচিত্র
দিনাজপুর জেলার মানচিত্র

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায় চারটি ইউপি সচিবদের (ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা) ডিলার সাজিয়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিক্রির লাভের টাকা বিএনপির উপজেলা সভাপতি মিঞা মো. শফিকুল আলম নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে উপজেলা বিএনপির সভাপতি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় উপজেলার কাটলা ইউনিয়নে ১ হাজার ৯৬ জন, খানপুর ইউনিয়নে ১ হাজার ১৪৪ জন, দিওড় ইউনিয়নে ১ হাজার ৪১৪ জন এবং পলিপ্রয়াগপুর ইউনিয়নে ৫৮৪ জন সুবিধাভোগী রয়েছেন। গত সপ্তাহে এসব সুবিধাভোগীর কাছে ১৫ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রি করা হয়েছে।

এই চার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সচিবদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল উত্তোলন ও বিক্রির জন্য খাদ্যদপ্তরের নিয়োগ করা ১৭ জন ডিলার রয়েছেন। এসব ডিলার ইউনিয়নভিত্তিক মোট সুবিধাভোগীর বিপরীতে কেজিপ্রতি ১৩ টাকা হারে টাকা ব্যাংকে জমা দিতেন।এরপর ডিলাররা খাদ্যগুদাম থেকে চাল তুলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সুবিধাভোগীদের কাছে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে বিক্রি করতেন। এতে প্রত্যেক ডিলার চাল বিক্রি করে কেজি প্রতি ২ টাকা লাভ করতেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছেন, সেখানে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিক্রি করতে ইউপি চেয়ারম্যান ও ডিলারদের বাধা দিয়েছেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অজুহাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নির্দেশে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের মাস্টাররোলে নির্ধারিত ডিলারের নামের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট ইউপি সচিবের নাম, ছবি ও মুঠোফোন নম্বর বসানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম উপজেলার চারটি ইউনিয়নে ৪ হাজার ২৩৪ জন সুবিধাভোগীর জন্য খাদ্যগুদাম থেকে ১২৭.১৪ মেট্রিক টন চাল কিনতে ইউপি সচিবদের নামে কেজিপ্রতি ১৩ টাকা হারে মোট ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৮২০ টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে জমা দিয়েছেন। পরে ইউপি সচিব এবং বিএনপি–সমর্থিত ইউপি সদস্য ও স্থানীয় বিএনপি নেতা–কর্মীদের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের কাছে ওই চাল ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হয়েছে। পরে চাল বিক্রি করে লাভের ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিএনপির নেতা শফিকুল আলম ইউপি সচিবের কাছ থেকে নিয়েছেন।

আমার ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১ হাজার ৪১৪ জন সুবিধাভোগী রয়েছেন। বিগত দিনগুলোতে এখানে তিনজন ডিলারের মাধ্যমে চাল বিক্রি করা হতো। এবার উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সেক্রেটারি ডিলারদের চাল উত্তোলনের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিতে দেননি।
আবদুল মালেক মণ্ডল, দিওড় ইউনিয়ন পরিষদ, বিরামপুর, দিনাজপুর

উপজেলার দিওড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১ হাজার ৪১৪ জন সুবিধাভোগী রয়েছেন। বিগত দিনগুলোতে এখানে তিনজন ডিলারের মাধ্যমে চাল বিক্রি করা হতো। এবার উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সেক্রেটারি ডিলারদের চাল উত্তোলনের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিতে দেননি। বিএনপি নেতারা নিজেরাই টাকা জমা দিয়েছেন। আর ইউপি সচিবের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের কাছে চাল বিক্রির পর লাভের টাকা ওই বিএনপি নেতারা নিয়েছেন। এবারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে উপজেলা প্রশাসন ও বিএনপি নেতারা আমাকে সম্পৃক্ত হতে দেননি।’

একই ইউনিয়নের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলার শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবার আমরা ডিলাররা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল তুলেছি এবং তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের কাছে বিক্রি করেছি। এবার উপজেলা খাদ্য অফিস থেকে আমাদের চাল তুলতে নিষেধ করা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমরা নাকি এবার চাল বিক্রির পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।’’ পরে এ ব্যাপারে জানতে ইউএনও অফিসে গিয়েছিলাম, সেখানে তিনি (ইউএনও) আমাদের কথাই বলতে দেন নাই।’

খানপুর ইউপির সচিব মোস্তফা জামান বলেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় এ ইউনিয়নে ১ হাজার ১৪৪ জন সুবিধাভোগী রয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পালাবদলের পর ইউএনওর নির্দেশে সচিবদের নামে খাদ্যগুদাম থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল তোলা হচ্ছে। আর চাল বিক্রির লাভের টাকা নিচ্ছেন উপজেলা বিএনপি নেতারা।

আমি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল তোলার জন্য কোনো ব্যাংকে টাকা জমা করিনি। আর কর্মসূচির চাল বিক্রির লাভের টাকা নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
মিঞা মো. শফিকুল আলম, সভাপতি, বিরামপুর উপজেলা বিএনপি

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের বাদ দিয়ে ইউপি সচিবদের মাধ্যমে চাল তুলে বিক্রি এবং চাল বিক্রির লাভের টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মিঞা মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘আমি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল তোলার জন্য কোনো ব্যাংকে টাকা জমা করিনি। আর কর্মসূচির চাল বিক্রির লাভের টাকা নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

এ বিষয়ে উপজেলা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুজহাত তাসনীম প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১৭ জন ডিলার রয়েছে। গত মাসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য কর্মসূচির চাল বিতরণ বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। পরে সব ডিলারকে ডাকা হয়েছিল। তাঁদের কেউই কর্মসূচির চাল তুলতে রাজি হননি। আর ডিলারদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি, এ কথা সঠিক নয়। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির নীতিমালা অনুযায়ী চাল বিতরণে ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে।