দিনাজপুরে ‘বাঁশের চালে’ রান্না হচ্ছে ভাত-পায়েস, দেখতে মানুষের ভিড়
বাঁশঝাড়ে জবুথবু শতাধিক বাঁশ। ঝরে গেছে লালচে শুকনা পাতা। বাঁশ ও কঞ্চির ফোঁড়ে ফোঁড়ে ঝুলছে ধানসদৃশ দানাদার ফল। সেই ফল সংগ্রহ করা হচ্ছে বস্তায়। ময়লা পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে চলছে মাড়াই। উৎপাদিত ‘চালে’ রান্না হচ্ছে ভাত, পায়েস ও খিচুড়ি।
এ ঘটনা দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকাপান গ্রামের। বাঁশের ফল থেকে ধানসদৃশ দানাদার শস্য সংগ্রহ করে এলাকায় হইচই ফেলে দিয়েছেন গ্রামের তরুণ সাঞ্জু রায় (২৫)। গত এক সপ্তাহে প্রায় সাত মণ দানাদার শস্য সংগ্রহ করেছেন। ইতিমধ্যে দুই মণ চাল পেয়েছেন। নিজে যেমন রান্না করে খেয়েছেন, তেমনি আশপাশের মানুষের কাছে বিক্রিও করেছেন প্রতি কেজি ৪০ টাকায়। এ ঘটনার সাক্ষী হতে দূরদূরান্ত থেকে নানা বয়সী মানুষ ছুটে আসছেন পাকাপান গ্রামে।
গতকাল রোববার সকালে পাকাপান গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সাঞ্জুর বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়ে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। বাঁশঝাড়ের নিচে পড়ে থাকা ধানসদৃশ দানাদার শস্য হাতে নেড়ে দেখছেন মানুষ। কেউ মুখে দিয়ে পরখ করছেন। কেউ ব্যাগ নিয়ে চাল কিনতে কিংবা চাল বদল করতে এসেছেন। এ সময় দানাদার শস্য কুড়িয়ে গামলায় তুলছেন সাঞ্জু এবং উৎসুক মানুষের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
অনেকের কাছে এ ঘটনা নতুন মনে হলেও পাকাপান গ্রামের ৭৯ বছর বয়সী নিতাই চন্দ্রের কাছে মোটেই তা নয়। তিনি বলেন, ‘হারা জানি এই বাঁশের নাম বেইড়া বাঁশ। বাঁশ ও কঞ্চির গিড়াত ধারালো কাঁটা আছে। ছোটবেলায় একবার বাঁশগাছে ফল ধরেছিল। সেই সময় আমরা ঢেঁকিত কুটি চাল বানেয়া খাইচি। আটা বানেয়া রুটিও খাইছি। কিছুদিন পরেই বাঁশঝাড়টি মারা যায়।’ তিনি জানান, এ বাঁশঝাড়টিও ইতিমধ্যে মরতে শুরু করেছে।
নিতাই চন্দ্রের কথার সূত্র ধরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রকিবুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত কয়েক প্রজাতির বাঁশে দীর্ঘ সময় পরে ফুল ও ফল আসে। ফলটি দেখতে ধানসদৃশ। ভারতের কিছু কিছু জায়গায় এই দানাদার ফসলটি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে মানুষ। এর পুষ্টিগুণ আছে। একই সঙ্গে যথেষ্ট ঔষধি গুণসম্পন্ন।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক আহসানুল কবির বলেন, বাঁশ মূলত ‘গ্রামিনি’ পরিবারের একীভূত সদস্য। এই পরিবারের অন্যান্য সদস্য ধান, গম, ভুট্টা ও সরগম। সাধারণত ৫০ বছরের অধিক সময় পরে বাঁশের জীবনচক্র শেষান্তে ফুল ও ফল আসতে পারে। তবে সেই ফল খাওয়া যায় কি না, এমন কোনো গবেষণা তাঁর জানা নেই।
আলাপচারিতায় সাঞ্জু রায় বলেন, কয়েক দিন আগে প্রতিবেশী এক চাচাসহ বাঁশঝাড়ের পাশে বসে গল্প করছিলেন। ওই সময় মাটিতে পড়ে থাকা দানাদার শস্যের বিষয়ে চাচার কাছে জানতে পারেন। বছর পঞ্চাশেক আগে ওই গ্রামে বাঁশের দানাদার বীজ থেকে চাল পেয়েছিলেন তিনি। ভাত রান্নাও করে খেয়েছেন। মানুষের অভাব ছিল সে সময়। এই কথা শোনার পর সেগুলো কুড়াতে শুরু করেন সাঞ্জু। আর তাতেই পেয়ে যান সাত মণ ধানসদৃশ বীজ।
সাঞ্জু রায় বলেন, বাঁশের কঞ্চিতে ফলগুলো শুকিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কঞ্চি ধরে নাড়া দিলে ঝরে পড়ছে। এ পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ ২০ কেজি সংগ্রহ করেছেন। এক কেজিতে চাল পেয়েছেন আধা কেজির মতো। রান্না করে খেয়েছেন। ভাতের মতোই স্বাদ। গত শনিবার পায়েসও রান্না করেছেন। আটা বানিয়ে রুটিও খেয়েছেন। ইতিমধ্যে আড়াই হাজার টাকার চাল বিক্রিও করেছেন। এখনো পাঁচ বস্তা মজুত আছে। ভালোই লাগছে।
সাধারণত কয়েক প্রজাতির বাঁশে দীর্ঘ সময় পরে ফুল ও ফল আসে। ফলটি দেখতে ধানসদৃশ। ভারতের কিছু কিছু জায়গায় এই দানাদার ফসলটি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে মানুষ। এর পুষ্টিগুণ আছে।
পাকাপান গ্রামে ছোট আকারের দুটি মাটির ঘর। স্ত্রী, দুই সন্তান, মা-বাবা নিয়ে সাঞ্জুর সংসার। উঠানের এক পাশে সাঞ্জুর মা সাবিত্রী রায়ের দেখা মিলল। স্তূপ করে রাখা শস্যদানা কুলায় তুলে ময়লা পরিষ্কার করছেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম ছেলের পাগলামি। পরে দেখি, সত্যি সত্যিই ধান। শুকিয়ে মিল থেকে চাল বানায় আনছে। আটাও করেছি।’
বাঁশগাছে পাওয়া দানাদার শস্যের চাল নিয়ে গেছেন পাড়ার সুনীল রায়, লিপি রানী ও কামিনী বালা। তাঁরা জানান, সাঞ্জুকে ধানের চাল বদল দিয়ে বাঁশের চাল নিয়েছেন এক কেজি করে। রান্না করে খেয়েছেনও। খুবই সুস্বাদু। খিচুড়িও রান্না করে খেয়েছেন বলে জানান কামিনী বালা।
ফুলবাড়ী উপজেলাতেই বাড়ি দিনাজপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী স্বাধীন চন্দ্র রায়ের। তিনি জানান, বাঁশের চালের কথা শুনে গতকাল বাড়িতে এসেছেন। ওই চালে তাঁর মা পায়েস রান্না করে খাওয়ালেন। খুবই ভালো স্বাদ। দেখতে একেবারে ধানের মতো। আকৃতিতে কিছুটা লম্বা ও সরু। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা বাঁশের ফুল, অবিকল ধানের মতো।
বাঁশের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বাম্বুসা ভালগারিস’। এটি মূলত ফাঁপা কাণ্ডবিশিষ্ট ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশ বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৪০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিভিকালচার জেনেটিকস বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, বাঁশে সাধারণত ফুল হয় না। তবে প্রজাতিভেদে ২৫ থেকে ৬০ বছর পরে ফুল আসতে পারে। ফুল আসা মানেই ওই বাঁশের জীবনচক্র শেষ হওয়া। বাঁশফলটা দেখতে অনেকটা ধানের বীজের মতো। এটি মূলত ইঁদুরের প্রিয় খাবার।