ছেলে পানিতে ভেসে গেছে, মানসিক ভারসাম্য হারান মা

সারাক্ষণই ছেলের জন্য চিৎকার করে কাঁদছেন আনসার সদস্য ওয়াহিদুর রহমান ওরফে ইরনের মা হাছিনা আকতার। ছেলে নেই এ কথাও বিশ্বাস করছেন না তিনি। হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য। আজ দুপুর ১২টায় মুন্সিরহাট ইউনিয়নের করইয়া বড় বাড়িতেছবি: সৌরভ দাশ

‘আঁর হুত বাড়িত কিল্লাই আইয়ে না। আঁরে হুতের কাছে লই ছল।’ (আমার ছেলে বাড়ি কেন আসে না। আামকে আমার ছেলের কাছে নিয়ে চলো)। এভাবে বিলাপ করতে করতে বুকে কিল মারছিলেন হাছিনা আকতার। পাশে বসে স্বামী বেলাল হোসেন ও মেজো ছেলে এয়াকুব মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাঁকে, পানি কমে গেলে ইরন বাড়ি আসবেন আর কয়েকটি দিন পর।

ফেনী ফুলগাজী উপজেলার করইয়া বড় বাড়ির ঘরে এভাবে আর্তনাদ করে চলেছেন হাছিনা। অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন তিনি। তাঁর ছোট ছেলে আনসার সদস্য ওয়াহিদুর রহমান ওরফে ইরন (২৪) ২৩ আগস্ট মায়ের কাছে ফেরার সময় বন্যার পানিতে তলিয়ে যান। ২৫ আগস্ট তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই দাফন করা হয় বাড়িসংলগ্ন একটা উঁচু জায়গায়। মা হাছিনাও ছেলের মরদেহ জড়িয়ে কান্নাকাটি করেন।

কিন্তু এখনো তিনি মনে করেন, তাঁর ছেলে মরেননি। আদরের ইরন বাড়ি ফিরবেন, এ প্রতীক্ষায় আছেন হাছিনা আকতার। টিনের ঘরটিতে এখন তাঁর দিন কাটে। ইরনের বাবা বেলাল হোসেন বলেন, ‘ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। কথাবার্তা অসংলগ্ন। এখনো আশায় আছে ইরন ফিরে আসবে। আমরা ভুলিয়ে রেখেছি।’

বেলাল-হাছিনা দম্পতির তিন ছেলে। বড় ছেলে দেশের বাইরে থাকেন। মেজো ছেলে এয়াকুব ঢাকায় একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ছোট ওয়াহিদুর রহমান ইরন দুই বছর আগে আনসার ভিডিপিতে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর কর্মস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখান থেকে বন্যাকবলিত বাড়িতে ফেরার সময় পানিতে ভেসে যান ইরন। ফেনীতে গত ২০ আগস্ট বন্যা দেখা দেয়। ফেনীর করইয়ার বাড়িতে ইরনের বাবা ও মা থাকেন। তাঁদের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি।

আজ করইয়ার টিনের ঘরটিতে কথা হয়, ইরনের বাবা ও মেজো ভাইয়ের সঙ্গে। পাশে বসা মা হাছিনা কখনো চুপচাপ কখনো বিলাপ করে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘আমি পানি ভেঙে ছেলের কাছে যেতে পারব, নিয়ে চলো।’

মায়ের সঙ্গে ইরনের ফোনে শেষ কথা হয় ২১ আগস্ট। বন্যার মধ্যে তখন তাঁকে বাড়িতে ফিরতে সবাই নিষেধ করেছিলেন। মেজো ভাই এয়াকুবও ছিলেন ঢাকার কর্মস্থলে। এয়াকুব বলেন, ‘২২ আগস্ট আমার সঙ্গে ইরনের ফোনে কথা হয়। আমি তাকে বাড়িতে যেতে বারণ করি। বলেছি, সেখানে পানি বেশি। আব্বা-আম্মুও বাড়ি ফিরতে নিষেধ করে। কিন্তু পরদিন ২২ আগস্ট সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফেনীতে রওনা হয়। পানি ডিঙিয়ে ফেনী সদর থেকে ফুলগাজী উপজেলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিন্তু পানি বেশি থাকায় ওই দিন করইয়ার দিকে যেতে পারেনি। ফুলগাজী উপজেলায় শাওন পাল নামের এক বন্ধুর বাসায় ছিল। এর মধ্যে ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়।’

ইরনের বাবা বেলাল বলেন, ছেলে ফুলগাজী থেকে ২৩ তারিখ সকালে কোমরসমান পানিতে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। কিন্তু বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পানির ঢেউয়ে ভেসে যায়। পরদিন জানতে পারি, সে নিখোঁজ। চারদিকে ছেলেকে খুঁজেছি। ২৫ আগস্ট পানি কমে গেলে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।’

ইরন ভেসে যাওয়ার খবর শুনে ভাই এয়াকুবও বাড়িতে চলে আসেন। তবে তিনি পৌঁছার আগেই মরদেহ দাফন করা হয় বাড়ির সামনে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ওয়াহিদের কাঁচা মাটির কবরটি দেখা যায়। কিন্তু হাছিনা বিশ্বাস করতে পারছেন না তা।

এয়াকুব বলেন, ‘ইরনকে খুব আদর করত আম্মু। এখন তার জন্য আম্মু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।’

এবারের ভয়াবহ বন্যায় কেবল ফেনীতেই এখন পর্যন্ত ২৩ জন মারা গেছেন।