ফরিদপুরে একটি বাঁওড়ের ইজারা নিয়ে আদালতে হওয়া মামলা নিষ্পত্তির আগেই ইজারাদারকে উচ্ছেদের অভিযোগ উঠেছে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এতে ইজারাদার আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তবে জেলা প্রশাসনের দাবি, নিয়ম মেনেই নতুন ইজারাদারকে বাঁওড় বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর ইউনিয়নের ধোপাডাঙ্গা বাঁওড়ে ওই অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। জলমহালটি থেকে আগের ইজারাদারকে উচ্ছেদ করে নতুন ইজারদারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে এ উচ্ছেদ অভিযান বিধিসম্মত হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আগের ইজারাদার টেপাখোলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি গুরুপদ বিশ্বাস।
ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর ইউনিয়নের ধোপাডাঙ্গা মহল্লায় ৩৫ একর জমির ওপর সরকারি এ বাঁওড় অবস্থিত। ২০২২ সালের ৮ জুন তিন বছর মেয়াদে বাঁওড়টি ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৮৯ টাকায় ইজারা নেন গুরুপদ বিশ্বাস। ইজারা নেওয়ার ১৪ মাস পর ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বাঁওড়টি বুঝে পান তিনি। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিবছর ইজারার টাকা নবায়ন সাপেক্ষে এ ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ৭ জুন।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মেয়াদ শেষের অন্তত ১৬ মাস আগে এবং বাঁওড়টি বুঝে পাওয়ার সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় গত ৩০ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার এক আদেশে ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করার অভিযোগে গুরুপদের ইজারা বাতিল করে দেন। পাশাপাশি ইজারা নেওয়ার সময় জমা রাখা জামানতের সব অর্থ বাজেয়াপ্ত করেন। জেলা প্রশাসনের অভিযোগ, গুরুপদ বিশ্বাস ২০২২ সালের ইজারার টাকা জমা দিয়েছিলেন। পরের বছর আর টাকা জমা দেননি।
গুরুপদ বিশ্বাস বলেন, ইজারা নেওয়ার ১৪ মাস পর তাঁকে বাঁওড়টির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কচুরিপানায় পরিপূর্ণ ওই বাঁওড় পরিষ্কার করা, চারপাশের খাল-নালা আবদ্ধ করাসহ বিভিন্ন কাজ করে জলাশয়টি মাছ চাষের উপযুক্ত করে তুলতে আরও ১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। ওই বাঁওড়ে বর্তমানে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার মাছ রয়েছে। ওই বাঁওড়ে মাছের পোনা ছাড়া, মাছের খাবার প্রদান করা, পাহারাদার নিয়োগসহ ইত্যাদি কাজে ধারদেনা করে অন্তত ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তিনি বুঝে পাওয়ার দিন থেকে হিসাব করে ইজারার টাকা পরিশোধ করেছেন।
প্রশাসন ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ অবস্থায় ইজারা বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক, সদরের ইউএনও এবং সদরের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বিবাদী করে একটি মামলা করেন গুরুপদ বিশ্বাস। গত ২৪ জুন আদালতের বিচারক মো. নাসির উদ্দিন ৩০ জানুয়ারি দেওয়া জেলা প্রশাসকের ইজারা বাতিলের আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন এবং ইজারার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জলমহালটি অন্যত্র ইজারা দেওয়া যাবে না বলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন।
রায়ের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক জজ কোর্টে আপিল করেন। ২ জুলাই জেলা জজ মো. আকবর আলী শেখ যুগ্ম জজ আদালতের দেওয়া আদেশের কার্যকারিতা পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন। এর দুদিন পর ৪ জুলাই স্থগিত আদেশ রহিত চেয়ে গুরুপদ বিশ্বাস আবেদন জানান, যার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা জজ আকবর আলী আপিলের পূর্ণাঙ্গ শুনানির দিন ২১ জুলাই ধার্য করেন।
এদিকে ফরিদপুরের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) দীপজন মিত্র তড়িঘড়ি করে ৩ জুলাই তিন কার্যদিবসের মধ্যে ওই জলমহালটি নতুন ইজারাদার ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের রণকাইল মাঝিপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে দখল প্রদানের জন্য আদেশ দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সম্রাট হোসেন ৫ জুলাই শুক্রবার ইজারাদার গুরুপদ বিশ্বাসের লোকজনদের সরিয়ে দিয়ে নতুন ইজারাদার রণকাইল মাঝিপাড়া মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মন্টু সরকারকে বুঝিয়ে দেন।
জানতে চাইলে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, জেলা জজ আদালত যুগ্ম জেলা জজ আদালতের আদেশ স্থগিত করেছেন। এ অবস্থায় নতুন ইজারাদারকে ওই বাঁওড় বুঝিয়ে দেওয়া আইনবহির্ভূত হয়নি। উচ্ছেদে ছুটির দিন বেছে নেওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষা চলমান রয়েছে। কার্যদিবসে অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এ জন্য ছুটির দিন এ অভিযান চালানো হয়েছে।
গুরুপদ বিশ্বাসের করা মামলার আইনজীবী মানিক মজুমদার বলেন, এ মামলায় নিম্ন আদালত যে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেটি জেলা জজ আদালত প্রাথমিক শুনানিতে স্থগিত করেছেন। আদালত নিষেধাজ্ঞার আদেশটি বাতিল করেননি। জেলা জজ আদালত পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য ২১ জুলাই ধার্য করেছেন। চূড়ান্ত শুনানি ও পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত বিচারাধীন জায়গায় আংশিক রায়ে তড়িঘড়ি করে ইজারাদার উচ্ছেদ কিংবা নতুন ইজারাদারকে বুঝিয়ে দেওয়া হলে তা হবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।