সিলেট, সুনামগঞ্জে বন্যা
সিলেটেই ক্ষতি হাজার কোটির বেশি, সহজ শর্তে ঋণের দাবি
দ্বিতীয় দফার বন্যায় সিলেট নগরের ২৪ ওয়ার্ড ও ১৩ উপজেলা প্লাবিত হয়। অনেক স্থানে লেনদেন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল।
সিলেটে দুই দফা বন্যায় কৃষি, মৎস্য, পর্যটন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় সিলেটের বিভিন্ন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে অনেক হাটবাজার ও দোকানপাট তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সংকট উত্তরণে ব্যবসায়ীদের সরকারি সহায়তার পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
একাধিক ব্যবসায়িক সংগঠন ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে জেলায় প্রতিদিন ৮–১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। গত ১৭ জুন শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফার বন্যায় নগরের ২৪টি ওয়ার্ড ও জেলার ১৩টি উপজেলা প্লাবিত হওয়ায় অনেক স্থানে লেনদেন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। কিছু এলাকায় এখনো পানি আছে। ফলে ব্যবসায়িক লেনদেন এসব এলাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে। অনেক ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে সংকটে পড়েছেন। তাই বন্যা শেষে তাঁরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন, সে দুশ্চিন্তায় আছেন।
এদিকে জেলায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত—সিলেটে এখনো বন্যা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, প্রাথমিক হিসাবে জেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বন্যা শেষে হিসাব করলে এ পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
জেলায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন জেলার ৩৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, টাকার হিসাবে যার ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসেন জানান, জেলায় তাঁদের ১৬০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার হিসাবে তা ১১৯ কোটি টাকা। তবে পুরোপুরি বন্যা কমলে এ ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ফরম-ডি’ নামে একটি ফরম আছে। এ ফরম অনুযায়ী বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। বন্যা পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি হলে জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করবে। তখনই কেবল বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব জানা সম্ভব হবে।
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দুই দিন ধরে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় সিলেট জেলার সব কটি নদ-নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। গতকাল রোববার বেলা তিনটা পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৮২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সিলেটের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটে গত শনিবার সকাল ছয়টা থেকে গতকাল সকাল ছয়টা পর্যন্ত ২১ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৯ মে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। ৮ জুনের পর বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। সর্বশেষ ১৭ জুন শুরু হওয়া টানা বৃষ্টিতে সিলেটে দ্বিতীয় দফায় ও সুনামগঞ্জে প্রথম দফায় বন্যা দেখা দেয়।
সুনামগঞ্জে ২৫০ কিমি সড়কের ক্ষতি
সুনামগঞ্জে বন্যায় গ্রামীণ সড়ক তছনছ হয়ে গেছে। বন্যার পানি কমায় বের হচ্ছে সড়কের ক্ষত। অনেক স্থানে এখনো সড়কের ওপর বন্যার পানি আছে। তবে এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জে বন্যায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ ও এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবারের বন্যায় বেশি ক্ষতি হয়েছে গ্রামীণ সড়কের। এ কারণে লোকজন যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। এখনো পুরোপুরি বন্যার পানি নামেনি। তাই সড়কের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ শতভাগ নিরূপণ করা যাচ্ছে না।
সওজ বিভাগের তথ্য বলছে, বন্যায় তাদের আওতাধীন ৯৫ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ছাতক-সিলেট সড়কের ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ অংশে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক, সুনামগঞ্জ-জামালঞ্জ সড়কেরও ক্ষতি হয়েছে।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, তাদের আওতাধীন গ্রামীণ সড়ক বেশি। বন্যায় এসব সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪০–১৬০ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হওয়ার তথ্য পেয়েছে তারা। তবে অনেক সড়কে এখনো পানি থাকায় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নেওয়া যায়নি।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা এলাকার বাসিন্দা মো. এরশাদ মিয়া বলেন, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের শক্তিয়ারখলা এলাকা সবার আগে ঢলের পানিতে ডুবে। এখনো পানি আছে। লোকজন চরম ভোগান্তিতে আছেন।
এলজিইডি সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিচ্ছি। পূর্ণাঙ্গ হিসাব পেতে আরও সময় লাগবে। গ্রামাঞ্চলের সড়কেই বেশি ক্ষতি হয়েছে।’
সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম প্রামানিক বলেন, ‘আমাদের যে সড়ক ক্ষতি হয়েছে, সেগুলোর জরুরি সংস্কার করতে ১৫ কোটি টাকা লাগবে। স্থায়ীভাবে কাজ করলে ২৫০ কোটি টাকার দরকার।’