পাবনার বেড়া
‘খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে আর ফেরে না পাখিগুলো’
জঙ্গলাকীর্ণ যে বাড়িকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই বাড়িতে এবার পাখির উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে।
পাবনার বেড়া উপজেলার কৈটোলা গ্রামের আকাশকলি দাস (৯০) সবার কাছেই ‘পাখিবন্ধু’ নামে পরিচিত। পাখির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে চলতি বছরের ৫ জুন তাঁকে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। পাখির প্রতি অকৃত্রিম প্রেমের কারণে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন-২০২৪’। পুরস্কার পাওয়ার সব আনন্দ এবারের শীত মৌসুমে একেবারেই মাটি হয়ে গেছে তাঁর। কারণ, তাঁর পাঁচ বিঘা আয়তনের জঙ্গলাকীর্ণ যে বাড়িটিকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই বাড়িতে এবার পাখির উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে।
শীতের শুরুতে অনেক পাখির আনাগোনা দেখা গেলেও শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমেই যাচ্ছে। প্রতিবছরের মতো এবারও শীতের শুরুতে বিভিন্ন ধরনের পাখি তাঁর বাড়ির গাছগুলোতে আশ্রয় নিলেও সকালে খাবারের সন্ধানে আশপাশের খাল, বিল ও চরাঞ্চলে গিয়ে শিকারিদের কবলে পড়ছে সেগুলো। ফলে দ্রুত কমে যাচ্ছে পাখির উপস্থিতি। আকাশকলি দাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘পাঁচ-ছয় বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি, শীতের শুরুতে প্রচুর পাখি এলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলোর সংখ্যা কমতে থাকে। আর এবার তো পাখি এমনিতেই কম এসেছে। সকালে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে আর ফেরে না পাখিগুলো। চোরা শিকারিদের কারণে দিন দিন এভাবেই পাখিগুলো কমে যাচ্ছে।’
মৎস্য অধিদপ্তরের ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (ডব্লিউবিআরপি) ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আকাশকলি দাসের বাড়িটিকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে। এই অভয়াশ্রমের পাখিগুলো সকালে খাবারের সন্ধানে সেখান থেকে বের হয়ে পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়ার বিভিন্ন খাল, বিল ও চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। এরপর সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে সেগুলো। তবে কয়েক বছর ধরে পাখিশিকারিদের কবলে পড়ে খাবারের সন্ধানে বের হওয়া অনেক পাখিই আর ঘরে ফিরতে পারছে না। সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার বিভিন্ন খাল, বিল ও চরাঞ্চলে এবার আগের চেয়ে আরও বেশি অবাধে পাখি শিকার চলছে। শৌখিন ও পেশাদার শিকারিরা বন্দুক, বিষটোপ, জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে এসব পাখি শিকার করছে। শিকার করা পাখি প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
বেড়ার মনজুর কাদের মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বেড়ার বিল ও চরগুলো থেকে দ্রুত পাখি উধাও হচ্ছে। বেড়ার ব্যতিক্রমী পাখি অভয়াশ্রমটিও পাখিশূন্য হতে বসেছে। শিকারিদের অপতৎপরতা বন্ধ করা না হলে জীববৈচিত্র৵ মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।’
বিল ও চরাঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, শীতের শুরুতেই বিলের পানি নেমে যায়। চরগুলোতেও সৃষ্টি হয় পাখির বিচরণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। এ সময় অল্প পানিতে মাছ ও খেতের আমন ধান খাওয়ার জন্য বিল ও চরগুলোতে প্রচুর দেশি ও অতিথি পাখি আসে। আর এ সুযোগে একশ্রেণির শৌখিন ও পেশাদার পাখিশিকারি মেতে উঠছেন পাখি নিধনে।
বেড়ার কাজলকুড়া, সাঁথিয়ার টেংরা ও ঘুঘুদহ বিল ঘুরে দেখা গেছে, একশ্রেণির চোরা শিকারি কারেন্ট জাল পেতে রেখেছেন। সেখানে বক, শামুকখোল, বালিহাঁস, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন দেশি ও অতিথি পাখি খাবারের সন্ধানে ওড়াউড়ির সময় জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। জাল থেকে শিকারিরা সেগুলো ছাড়িয়ে ঝুড়িতে ভরে রাখছে। সম্প্রতি এমন দৃশ্য দেখে শিকারিদের ছবি তুলতে গেলে তাঁরা ভুল স্বীকার করে পাখিগুলো ছেড়ে দেন এবং আর কখনো পাখি ধরবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। তবে পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দু–এক দিন পরেই তাঁরা আবারও পাখি শিকার শুরু করেছেন।
সম্প্রতি বেড়া বাজারে একটি রিকশাভ্যানের ওপর খাঁচাভর্তি বক বিক্রি করতে দেখা যায়, আলমগীর হোসেন ও মন্টু মিয়া নামের দুই পাখি বিক্রেতাকে। প্রতি জোড়া পাখি বিক্রি করা হচ্ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। তাঁরা নিজেরা পাখি শিকার করেন না বলে দাবি করেন। শিকারিদের কাছ থেকে প্রতি জোড়া ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় কিনে বাজারে এনেছেন বলে জানান। তাঁদের চেনা–জানা ১০ থেকে ১২ জন শিকারি জালের সাহায্যে বিল ও চরে গিয়ে বক, বালিহাঁস, পানকৌড়ি প্রভৃতি পাখি ধরে আনেন।
রাজশাহী বিভাগীয় বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘শীতকালে দেশি ও অতিথি পাখির বিচরণ বেড়ে যায় বলে অবৈধ পাখিশিকারিদের অপতৎপরতাও বেড়ে যায়। আমরা প্রতিদিনই পাখিশিকারিদের ধরতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়া সচেতনতামূলক নানা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচিও করে যাচ্ছি। কেউ যদি আমাদের অবৈধ পাখিশিকারির বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারেন, তাহলে তথ্যদাতাকে আমরা নগদ অর্থ দিয়ে পুরস্কৃতও করছি।’
অনেকটা একই রকম তথ্য দিলেন সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বন্য প্রাণী আইনে পাখি শিকার একেবারেই নিষিদ্ধ। এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।