রুমি আক্তার ফারজানার দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছিল। কোলে থাকা এক মাস বয়সী শিশু সন্তানও কাঁদছিল। রুমির কান্না স্বামীকে হারানোর ব্যথায়। কিন্তু অবুঝ শিশু বুঝতে পারছিল না চিরদিনের মতো সে তাঁর বাবাকে হারিয়েছে। সন্তান বাবা হারা হল, আর কীভাবে চলবে সামনের দিনগুলো- সেই চিন্তায় ছেলে হুসাইনকে কোলে নিয়ে ডুকরে কাঁদছিলেন রুমি।
রুমি আক্তার গাজীপুরের কালিয়াকৈরের তেলিরচালা এলাকায় আগুনে পুড়ে নিহত ইয়াসিন আরাফাতের (২১) স্ত্রী। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইয়াসিন মারা যান।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ইয়াসিন বাসচালকের সহকারী ছিলেন। তিনি কুষ্টিয়া পৌরসভার উদিবাড়ি এলাকার আল-আমীনের ছেলে। মা আয়েশা খাতুন স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দুই ছেলেকে নিয়ে গাজীপুরের একটি ঝুট কারখানায় কাজ করে জীবন চালাতেন। দেড় বছর আগে ছোট ছেলে ইয়াসিনের বিয়ে দেন। ইয়াসিন এক মাস বয়সী ছেলে হুসাইন ও স্ত্রী রুমিকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকতেন।
বুধবার সকালে নিহত ইয়াসিনের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স তাঁর নানাবাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার গোপগ্রাম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গোপগ্রামে আনা হয়। সেখানে দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে গোপগ্রাম কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাঁর দাফন করা হয়।
রুমি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন বিকেলে ইয়াসিন মুঠোফোনে জানায়, তাঁর মা কাজ শেষ করে বাসায় ফিরলে তিনিও ইফতারিতে বাসায় ফিরবেন। কিন্তু কিছু সময় পরই প্রতিবেশী এক ছেলে এসে তাঁকে (রুমি) জানায়, পাশের বাড়ির গ্যাসের আগুনে ইয়াসিন পুড়ে গেছে (দগ্ধ হয়েছে)। এর পর থেকে প্রায় সারা রাত শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে শাশুড়ির হাত ধরে স্বামীর খোঁজে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটেছেন রুমি।
প্রায় ১২ ঘণ্টা পর জানতে পারেন দগ্ধ ইয়াসিনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। গতকাল দুপুরে শাশুড়ির সঙ্গে রুমি আক্তার দগ্ধ স্বামীর কাছে যেতে পারেন। রুমির সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ ইয়াসিনের শেষ কথা হয় বার্ন ইউনিটে। তখন সন্তান হুসাইনকে দেখতে চেয়েছিল ইয়াসিন। কিন্তু হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্সরা শিশুকে তার বাবার কাছে নিতে দেননি।
স্বামীর শেষ ইচ্ছা ও শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিলাপ করছিলেন রুমি আক্তার। তিনি বলেন, ‘এই শিশু নিয়ে এখন কার কাছে যাব? অভাবের সংসারে ছেলেকে কীভাবে মানুষ করব? কার কাছে আশ্রয় নেব?’ স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
ইয়াসিনের মা আয়েশা খাতুন বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি গাজীপুরে চলে যান। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি সেখানে ছেলেদের নিয়ে পোশাক কারখানায় ঝুটের কাজ করে জীবন চালাতেন। বড় ছেলের পর দেড় বছর আগে ছোট ছেলে ইয়াসিনকে বিয়ে দেন। ছেলে ও নাতিদের নিয়ে একসঙ্গে থাকতেন। এখন কী নিয়ে থাকবেন জানেন না।
১৩ মার্চ সন্ধ্যায় গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা টপস্টার কারখানার পাশে একটি কলোনিতে গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে অগ্নিদগ্ধ হন ইয়াসিনসহ সেখানকার ৩৬ জন বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে ৩৪ জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।