শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে লাখ লাখ মুসল্লি
বয়সের ভারে ন্যুব্জ আশরাফ আলী। বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা এলাকায়। শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ ও মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি বলছিলেন, তাঁর বয়স ৯১ বছর। ১৯৪৯ সালে চাচার মমরুজ আলীর সঙ্গে প্রথম শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে আসেন। সেই থেকে শুরু। এরপর প্রতিবারই তিনি শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ আদায় করছেন।
এ রকম অসংখ্য মুসল্লির সমাগমে ঐতিহাসিক শোলাকিয়ায় অনুষ্ঠিত হলো এবারের ঈদুল ফিতরের নামাজ। এই ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে এক দিন আগেই অনেক মুসল্লি চলে আসেন। ভোর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলাসহ দূরদূরান্ত থেকে আসা ও স্থানীয় লাখো মুসল্লির সমাগম ঘটে ঈদগাহে। নামাজ শুরুর এক ঘণ্টা আগে সকাল ৯টার দিকে মাঠ কানায়-কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।
নামাজ শুরু হয় সকাল ১০টায়। শোলাকিয়ায় এবার ছিল ১৯৭তম ঈদুল ফিতরের জামাত। জেলা শহরের বড় বাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা শোয়াইব বিন আবদুর রউফ নামাজের ইমামতি করেন। প্রায় ৭ একরের মূল মাঠ ছাড়িয়ে পাড়া-মহল্লায় দাঁড়িয়েও শোলাকিয়ার ঈদের জামাতের সঙ্গে শরিক হয়েছেন অনেকে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, শোলাকিয়ায় প্রতিবারের মতো এবারও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। লাখ লাখ মুসল্লি স্বস্তিতে নামাজ আদায় করেছেন। স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত ১০ বছরে শোলাকিয়ায় এত মুসল্লি হয়নি। এবার ৫ লক্ষাধিক মুসল্লির সমাগম হয়েছে। নামাজ শেষে দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনায় মোনাজাত হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ভোর থেকে মুসল্লিরা আসতে শুরু করেন। সকাল ৯টার দিকে মাঠ কানায়-কানায় ভরে যায়। শোলাকিয়া মাঠের রেওয়াজ অনুযায়ী, বন্দুকের ফাঁকা গুলির মাধ্যমে সকাল ১০টায় জামাত শুরু হয়। মুসল্লিদের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে মুখর ছিল ময়দান।
৭৫ বছর বয়সী হারুন অর রশিদ এসেছেন নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার লেবুতলা এলাকা থেকে। তিনি বলেন, ‘বড় মাঠে দোয়া কবুল হয়, সেই বিশ্বাসেই ১০ বছর বয়স থেকে এলাকার লোকদের সঙ্গে প্রথম শোলাকিয়া নামাজ পড়তে আসি। এখনো আসছি। আল্লাহ যত দিন বাঁচিয়ে রাখে, তত দিনই আসব। সেই ছোট্টবেলা থেকেই এ মাঠে লাখো মুসল্লির সমাগম দেখে আসছি। দিন দিন যেন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে।’
দেশের সবচেয়ে বড় এই ঈদের জামাত নির্বিঘ্নে করতে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনের। মোতায়েন করা হয়েছিল র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ), পাঁচ প্লাটুন বিজিবি এবং জেলা পুলিশের সহস্রাধিক সদস্য।
মাঠের ভেতর ও বাইরে ছিল অর্ধশতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা, পুরো মাঠ পর্যবেক্ষণের জন্য ছিল বেশ কয়েকটি ড্রোন। ছয়টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে আগত ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ ছাড়া মাঠের ভেতর-বাইরে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তায় ছিল বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক দল। নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে ছাতা বা কোনো ধরনের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শুধু পাতলা জায়নামাজ নিয়ে নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মুসল্লিদের যাতায়াতে দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়ায় বড় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হজরত খাঁ কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর এ ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে মাঠের জমির পরিমাণ আরও বাড়ানো হয়। শোলাকিয়া ওই অঞ্চলের তৎকালীন জমিদারের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।
এ ছাড়া শোলাকিয়া মাঠ নিয়ে দুটি জনশ্রুতির বর্ণনা রয়েছে। এর একটি হলো, মোগল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল শ লাখ টাকা। মানে এক কোটি টাকা। কালের বিবর্তনে শ লাখ থেকে বর্তমান শোলাকিয়া হয়েছে। আরেকটি বর্ণনায় আছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে এটি শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কাছে পুলিশ সদস্যদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ সময় পুলিশের দুই সদস্য, স্থানীয় এক নারী, পুলিশের গুলিতে একজন সন্ত্রাসীসহ সেদিন চারজন নিহত হয়েছিলেন। সেই থেকে ঈদের জামাতে এ মাঠে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়।