রূপগঞ্জে সেলিম প্রধানের বাড়ি ভাঙচুর, পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অনলাইন ক্যাসিনো–কাণ্ডে আলোচিত সেলিম প্রধানের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেলিম প্রধানের মালিকানাধীন একটি আড়তের দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে আজ শুক্রবার সকালে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুপুরে সেলিম প্রধান ও তাঁর মালিকানাধীন আড়তের ভাড়াটে মজিবুর রহমান পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
সকাল আটটার দিকে রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল এলাকায় বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে একদল মুখোশ পরিহিত লোক দেশি অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছেন বলে সেলিম প্রধানের অভিযোগ। সরেজমিনে সেলিম প্রধানের বাড়িতে হামলায় ব্যবহৃত লাঠিসোঁটা, ইটপাটকেল ও ভাঙা কাচ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
দুপুর সাড়ে ১২টায় নিজের ভাঙচুর হওয়া বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন সেলিম প্রধান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আড়তের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে তাঁর রুশ স্ত্রীসহ সন্তানদের ওপর হামলার অভিযোগ করেন।
সেলিম প্রধান দাবি করেন, জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর এক স্বজনের মাধ্যমে মজিবুর রহমান জাল স্বাক্ষর ব্যবহার তাঁর (সেলিম) মালিকানাধীন ১৬ বিঘা জমি ভাড়া নেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর বিষয়টি জানতে পেরে তিনি তাঁর জমি ফেরত চান। চুক্তি অনুযায়ী সাত মাস আগে জমি ফিরে পেতে ভাড়াটেদের তিনি আইনি নোটিশ পাঠান। থানায় অভিযোগ করেন। এর মধ্যে ২১ মে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু হলে সেলিম প্রধান চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আবু হোসেনের (আনারস প্রতীক) পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনে অপর প্রার্থী হাবিবুর রহমান (দোয়াত-কলম প্রতীক) বিজয়ী হওয়ার পর আজ তাঁর বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়।
সেলিম প্রধান বলেন, হামলায় তাঁর গোলাকান্দাইল এলাকার বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। মারধর করে তুলে নেওয়া হয়েছিল তাঁর বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের। পরে পুলিশের সহায়তায় তাঁদের ফেরত আনা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়াটেদের কাছ থেকে অন্তত আড়াই কোটি টাকা বকেয়া ভাড়া পাবেন বলেও দাবি করেন সেলিম প্রধান।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনের পর বেলা সাড়ে তিনটায় আবার সেলিম প্রধানের বাড়িতে হামলার অভিযোগ পাওয়া যায়। সেলিম প্রধান প্রথম আলোকে জানান, হাবিবুর রহমান ও মজিবুর রহমানের লোকজন মোটরসাইকেলে করে মহড়া দিয়ে তাঁর বাড়িতে হামলা চালান।
সেলিম প্রধানের সংবাদ সম্মেলনের আধঘণ্টা আগেই দুপুর ১২টায় ভাঙচুর করা ওই বাড়ির পাশের আড়তে সংবাদ সম্মেলন করেন আড়তটির ভাড়াটে মজিবুর রহমান। আড়তের ব্যবসায়ীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে মজিবুর রহমান দাবি করেন, ২০১৯ সালে ১০ বছর চুক্তিতে সেলিম প্রধানের মালিকানাধীন ১৬ বিঘা জমি ভাড়া নেন তিনি। পরে রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা পরিষদের সদ্য বিজয়ী চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান এবং রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মীর আবদুল আলীম যৌথভাবে সেখানে বালু ভরাট করে প্রায় সাড়ে ৩০০ দোকানের একটি আড়ত গড়ে তোলেন। তারপর প্রায় তিন বছর তাঁরা সেলিম প্রধানকে মাসিক সাড়ে সাত লাখ টাকা আড়তের ভাড়া দেন। এরই মধ্যে সেলিম প্রধান জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁর বাহিনী দিয়ে আড়তটি দখলে নেন। আড়তের পুরোনো ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা আদায় করেন। এতে তাঁরা প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েন।
চুক্তি অমান্য করে আড়ত দখলে নেওয়ার বিষয়ে বারবার প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন মজিবুর।
কবির হোসেন নামের আড়তের এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে সেলিম প্রধান লোকজন নিয়ে জোর করে তাঁর দুটি দোকান দখলে নেন। এ সময় সেলিম প্রধানের লোকজন তাঁর দোকানের ক্যাশবাক্স ভেঙে টাকা লুট করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মজিবুরের করা অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিম প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনি নোটিশের পর মজিবুরসহ তাঁর অংশীদারদের সঙ্গে আমার দুই দফায় বৈঠক হয়। তখন পারস্পরিক সমঝোতায় আমি আমার আড়ত বুঝে নিই। কোনো হামলার ঘটনা তখন ঘটেনি।’
সেলিম প্রধানের বাড়িতে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মজিবুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর বাড়িতে আমাদের কেউ হামলা করেনি। তিনি নিজেই নিজের বাড়ির কাচ ভাঙচুর করে নাটক সাজিয়েছেন।’
এদিকে হামলা ও পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনের ঘটনায় গোলাকান্দাইল আড়ত এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িঘরে হামলার খবর পেয়ে সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ তৎপর রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনলাইন ক্যাসিনো–কাণ্ডে সেলিম প্রধান আলোচিত নাম। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাইল্যান্ডগামী ফ্লাইট থেকে নামিয়ে এনে সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর তাঁর বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ জব্দ করা হয়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলেছিল, সেলিম প্রধান বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো বা অনলাইন জুয়ার মূল হোতা। তিনি প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।
সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে দুদক একটি মামলা করে। এ ছাড়া ঢাকার গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে তিনটি মামলা হয়। বিচারাধীন এসব মামলায় জামিনে রয়েছেন তিনি।
২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল দুদকের করা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। তাতে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের দুই ধারায় সেলিম প্রধানকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। ইতিমধ্যে তাঁর সাজাভোগ শেষ হওয়ায় এবং বাকি মামলায় জামিন পাওয়ায় গত বছরের অক্টোবরে মুক্তি পান তিনি। সাজার বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে যে আপিল করেছেন, সেটা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
যদিও কারামুক্তির পর থেকে সেলিম প্রধান দাবি করছেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধের জেরে তাঁকে ষড়যন্ত্রমূলক অনলাইন ক্যাসিনো–কাণ্ডে ফাঁসানো হয়েছে।