ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে গৃহবধূ ও তাঁর দুই সন্তানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন গৃহবধূর ভাগনি জামাই জহিরুল ইসলাম। স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে থাকা বিরোধ মেটানোর জন্য আলোচনা করতে তিনি প্রবাসীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। আলোচনার সময় কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে খালাশাশুড়িকে কুপিয়ে হত্যা করেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখে ফেলায় তাঁর দুই সন্তানকে একে একে হত্যা করেন জহিরুল।
আজ বুধবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্বাগত সাম্য জহিরুলের জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন। সন্ধ্যায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অভিযান) সোনাহর আলী শরীফ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মো. সিরাজুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আইয়ুবপুর ইউনিয়নের চরছয়ানী দক্ষিণপাড়া গ্রামের সৌদিপ্রবাসী শাহ আলমের বাড়ির দরজা ভেঙে তাঁর স্ত্রী জেকি আক্তার (৩৬) এবং দুই সন্তান মাহিন ইসলাম (১৬) ও মহিন ইসলাম ইসলামের (৭) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় শাহ আলমের সাত মাস বয়সী শিশুকন্যা ওজিহাকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়।
গ্রেপ্তার জহিরুল ইসলাম (২৫) নরসিংদী সদর উপজেলার নূরালাপুর ইউনিয়নের আলগীচর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি নিহত জেকি আক্তারের বড় বোন শিল্পী আক্তারের মেয়ে আনিকা আক্তারের স্বামী। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গতকাল দিবাগত রাতে জহিরুলকে নরসিংদীর মাধবদী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আজ সকালে জেকির বাবা আবুল হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় মামলা করলে জহিরুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
জবানবন্দির বরাত দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাংসারিক বিষয় নিয়ে স্ত্রী আনিকার সঙ্গে জহিরুলের বিরোধ চলছিল। স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির সহায়তা চাইতে গত সোমবার রাতে খালাশাশুড়ি জেকি আক্তারের বাসায় যান জহিরুল। আলোচনার সময় জেকি আক্তারের সঙ্গে জহিরুলের কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে বঁটি দিয়ে জেকির মাথার পেছনে ও ঘাড়ে কোপ দেন জহিরুল। এ সময় ঘুমিয়ে থাকা মাহিন জেগে উঠে চিৎকার দিয়ে জহিরুলকে থামাতে যায়। তখন জহিরুল তাকেও বঁটি দিয়ে কোপ দেন। মাহিন বাঁচার জন্য দৌড়ে নিজের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধের চেষ্টা করে। জহিরুল তাঁকে টেনেহিঁচড়ে মায়ের পাশে ফেলে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলে শিশু মহিন অসহায়ের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। জহিরুল তখন ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ পায়চারি করেন। মহিন তাঁকে চেনে এবং ঘটনা বলে দিতে পারে ভেবে ধারালো বাটাল নিয়ে মহিনের দিকে এগিয়ে যায়। তখন ভয়ে সে শৌচাগারের দিকে দৌড় দেয়। মহিনকে শৌচাগারের দরজার সামনে ধরে কণ্ঠনালির নিচে বাটাল ঢুকিয়ে দেন জহিরুল। পরে শিশুটির মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ শৌচাগারে ফেলে রাখেন। পরে রক্তাক্ত লুঙ্গি পলিথিনের ব্যাগে ভরে বাড়ির প্রধান ফটক বাইরের দিক থেকে তালা লাগিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন জহিরুল। জহিরুলের ফুলহাতা শার্ট, বঁটি ও ধারালো বাটাল জব্দ করেছে পুলিশ।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, বড় বোন শিল্পী আক্তারের পরিবারে নিহত জেকির প্রভাব ছিল। গত ডিসেম্বরে বড় বোনের মেয়ে আনিকার সঙ্গে জহিরুলের বিয়ে হয়। আনিকা এখন অন্তঃসত্ত্বা। বিয়ের পর থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে আনিকার বনিবনা হচ্ছিল না। স্বামীর বাড়িতে কিছু হলেই আনিকা বিষয়টি তাঁর মা–বাবার কাছে অভিযোগ করতেন। জহিরুলের বিষয়ে খালাশাশুড়ি জেকির নেতিবাচক মনোভাব ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) জয়নাল আবেদীন, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বাঞ্ছারামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
নিহত জেকির বাবা আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আনিকা স্বামীর বাড়িতে যেতে চাচ্ছিল না। তাঁর বড় মেয়ে ও স্বামীও মেয়েকে যেতে দিচ্ছিলেন না। এ জন্য সোমবার সকালে জহিরুল তাঁর আরেক মেয়ে জেকি আক্তারের বাসায় গিয়ে আনিকাকে বোঝানোর অনুরোধ করেন। জেকি বিষয়টি নিয়ে জহিরুলকে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এরপর জহিরুল চলে যান। জহিরুল রাতে আবার জেকির বাসায় যান। তাঁর আসার বিষয়টি শ্বশুর-শাশুড়িকে বলতে নিষেধ করেন। কিন্তু জেকি মুঠোফোনে বিষয়টি বড় বোন শিল্পীকে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জহিরুল জেকি ও তাঁর দুই সন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করেন।