‘দালাল কইছে ছেলেকে ফিরাইয়া দিবে, তার দিকে চাইয়া আছি’

তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত সজীব কাজীর বাড়িতে স্বজনদের আহাজারি। মঙ্গলবার বিকেলে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মৃত্যু হওয়া ৯ জনের মধ্যে ৫ জন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ও তিনজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর এলাকার বাসিন্দা। আজ মঙ্গলবার সকালে লিবিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে তরুণদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে তাঁদের পরিবারে বইছে কান্নার রোল। আদরের সন্তানকে হারিয়ে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ।

আরও পড়ুন

মৃতরা হলেন মাদারীপুরের রাজৈরের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), সেনদিয়ার গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪), কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার (২২), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের দাদন মিয়ার ছেলে রিফাদ (২১), ফতেয়পট্টি এলাকার মো. রাসেল (২০) ও গয়লাকান্দি গ্রামের পান্নু শেখের ছেলে ইসরুল কায়েস আপন (২২)। এই দুর্ঘটনায় আরও এক পাকিস্তানি নাগরিকও মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

নিহতের স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বেশ কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা হয়। প্রথমে তাদের নেওয়া হয় দুবাই। সেখানে কয়েক দিন থাকার পরে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। পরে দালালের মাধ্যমে অভিবাসনপ্রত্যাশী এসব তরুণদের একটি ‘গেম ঘরে’ নেওয়া হয়। ঘর থেকেই গত বুধবার লিবিয়ার উপকূল থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণদের নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছেড়ে যায়। নৌকাটি তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করলে ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। পরে ওই নৌকায় আগুন ধরে যায়। এরপরই ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায় নৌকাটি। এতে সজীব কাজী, মামুন শেখ, সজল বৈরাগী, নয়ন বিশ্বাস, কাওসার, আপন, রাসেল ও রিফাদের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এক পাকিস্তানি নাগরিকও মারা যান। খবর পেয়ে কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে গোপালগঞ্জের গয়লাকান্দি গ্রামের ইসরুল কায়েস আপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির লোকজন মানতেই চান না আপন আর নেই। ইসরুল কায়েস আপনের বাবা পান্নু শেখ বলেন, ‘আমার ছেলে মারা গেছে, আমি বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাস, আমার ছেলে ফিরে আসবে। ছেলে জন্য দুসম্পর্কের এক বিয়াইয়ের মাধ্যমে ১১ লাখ টাকা দিছি। দালাল কইছে ছেলেকে ফিরাইয়া দিবে, তার দিকে চাইয়া আছি।’

রাজৈরের বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের সজীব কাজীর বাড়ি স্বজনদের কান্নাকাটি চলছিল। প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সজীব কাজীর চাচাচো ভাই মেহেদী কাজী বলেন, ‘এভাবে আমার ভাই মারা যাবে এটা কখনই ভাবতেই পারি নাই। ভাই নাই ভাবতে গেলেই বুকফাটা কষ্ট হচ্ছে। টাকা নেওয়ার আগে দালালের কথা মধু থাকলেও টাকা নেওয়ার পরে দালালদের কাজের সাথে কথার কোন মিল আমরা পাই নাই। আমরা আইনি সহায়তা নেব। দালালদের কঠোর বিচার চাই আমরা।’

তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত সজীব কাজীর স্বজনরা এখনো তাঁর ফেরার অপেক্ষা করছেন
ছবি: প্রথম আলো

সজীবের বাবা মিজানুর রহমান কাজী বলেন, ‘ধারদেনা কইরা, জমি বেইচা পোলাডারে বিদাশ করতে পাঠাই। শেষ কালে এমন দিন দ্যাখবার লাগবো চিন্তাও করি নাই। পোলাডা বাইচা নাই, বুঝতাছি। শেষ কথা, পোলাডা কইছিল, “আব্বা গেম হইবে, দোয়া কইবো, আম্মারে আমার সালাম জানাইও, ইতালি পৌঁছে ফোন দেওয়ার কথাও কইছে”। পোলাডার আর ইতালি পৌঁছানো হইল না।’

আদরের সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা কদমবাড়ির ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের নয়ন বিশ্বাসের বাবা কৃষক পরিতোষ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ছেলের জন্য ধারদেনা করে ১০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠাই। চার-পাঁচ দিন ধইরা যোগাযোগ নাই। তখনই বুঝছি ছেলেডা আর বাইচা নাই। মানসিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েছি। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া, ছেলেডার লাশ যেন দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা করে।’

স্বজনদের অভিযোগ, মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের গজারিয়া গ্রামে রহিম শেখ ও রাঘদি ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয়। দুর্ঘটনার পর থেকেই এই চক্রের সদস্য সবাই পলাতক। তাঁদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় দালালচক্র। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা চলমান। সম্প্রতি তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে মাদারীপুরের পাঁচজনসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি মারা গেছে। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে মামলা নেওয়ার পাশাপাশি দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষকে সচতেনও হতে হবে। তা না হলে এমন দুর্ঘটনা মৃত্যু কখনই কমবে না।