নারায়ণগঞ্জে আগুনে সরকারি-বেসরকারি ১৩ ভবন ধ্বংসস্তূপ

আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়। মঙ্গলবার তোলা ছবি। প্রথম আলো

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত বৃহস্পতিবার রাতে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় চারতলাবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়। ভবনটির সবকিছু পুড়ে গেছে। ভবনের সার্ভার স্টেশন, কম্পিউটার, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, আসবাবসহ সবকিছু পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে গেছে আট হাজারের বেশি পাসপোর্ট ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাগজপত্র। এককথায় আঞ্চলিক এই পাসপোর্ট কার্যালয়ের কিছুই অবশিষ্ট নেই।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় আঞ্চলিক ওই পাসপোর্ট কার্যালয়। মঙ্গলবার সকালে সেখানে গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। তিন বছর আগে নির্মিত ওই কার্যালয়ের এ অবস্থা দেখে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ভবনের প্রতিটি তলায় আগুনে পোড়ার চিহ্ন। আগুনের খবর পেয়ে নেভাতে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ফলে তিন দিন ধরে আগুন জ্বলেছে ভবনটিতে।

আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়টির উপপরিচালক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আগুনে কার্যালয়ের সবকিছু পুড়ে গেছে, ব্যবহার করার মতো কিছুই নেই। আট হাজারের বেশি পাসপোর্ট পুড়ে গেছে।

পাসপোর্টের ওই আঞ্চলিক কার্যালয়ের মতো হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভবন, শিমরাইলে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ভবন, শিল্প পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, ২৬টি শীতল পরিবহনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ ১৩টি প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে গাড়িসহ বিভিন্ন আসবাব। ভাঙচুর করা হয়েছে শহরের ২ নম্বর রেলগেট পুলিশ বক্স, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেড, আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার, ভূঁইগড় এসবি গার্মেন্টসসহ অর্ধশতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

সাইনবোর্ড এলাকায় ছয়তলা ভবনের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় জেলা পিবিআই কার্যালয়। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে দুর্বৃত্তরা সেখানে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ সময় ছয় পিবিআই সদস্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে জেলা পুলিশ ও বিজিবি এসে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এ সময় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পরে দুর্বৃত্তরা অস্ত্র লুট, রাতে পাঁচটি গাড়ি, ছয়টি মোটরসাইকেল ও ভবনটিতে আগুন দেয় এবং লুটপাট চালায়।

পিবিআই পরিদর্শক মো. সাকিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াত–শিবিরের নেতৃত্বে এলাকার উচ্ছৃঙ্খল পোলাপান, পেশাদার চিহ্নিত অপরাধী, চোর–ডাকাত মিলে কয়েক হাজার লোক একযোগে তালা ভেঙে অফিসে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। মামলার নথি, রেজিস্ট্রারসহ সবকিছু পুড়িয়ে ফেলে।’

অন্যদিকে গত শনিবার বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় হাজী ইব্রাহিম খলিল শপিং কমপেক্সে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওই ভবনের নিচতলায় দোকানপাট, দোতলায় বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখা, তিনতলায় রেস্তোরাঁ, চারতলায় মা হসপিটাল, সাততলায় হাইওয়ে পুলিশের ফাঁড়ি অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে। ওই ভবনের দোতলা ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের ভেতর থেকে গত সোমবার দুপুরে তিন শ্রমিকের আগুনে পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁরা ব্যাংকের ভেতরে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করছিলেন।

ওই ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী মো. হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক হাজার দুর্বৃত্ত তাঁদের ভবনে আগুন দেয়। ভবনে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির অফিসে কয়েক পুলিশ সদস্য আটকা পড়লে প্রশাসনের লোকজন গোলাগুলি করে হেলিকপ্টারে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যান। ব্যাংকের ভেতর থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

শহরের মণ্ডলপাড়া এলাকায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে গত শুক্রবার রাতে দুর্বৃত্তরা হামলা, ভাঙচুর, পাঁচটি গাড়ি ও সাতটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ায় আগুনের পুড়ে যাওয়া ভবনগুলোতে লোকজন আসা শুরু করেছেন। অফিসগুলোতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি ও লুটপাট হয়েছে, তা নিরূপণের কাজ চলছে।

এ বিষয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আমীর খসরু প্রথম আলোকে বলেন, নাশকতা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। সাইনবোর্ডে গোলাগুলিতে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গোলাকান্দাইলে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন তারাব পৌর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আহাদসহ গত দুই দিনে মোট ২৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, যারা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।