বারবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ফুলপরী ও তাঁর বাবা
বুধবার বেলা তিনটা! আইন বিভাগের এক শিক্ষকের কক্ষে ঢুলছিলেন ভ্যানচালক আতাউর রহমান। তিনি কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রলীগ নেত্রীদের নির্যাতনের শিকার ফুলপরী খাতুনের বাবা।
দরজায় শব্দ শুনে আতাউর উঠে পড়েন। তিনি বলেন, রাতে ঘুম হয় না। আবার কষ্ট করে ক্যাম্পাসে আসতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এ জন্য একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
এ সময় সামনের কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রেবা মণ্ডলের কক্ষে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সানজিদা চৌধুরী ওরফে অন্তরা, তাবাসসুমসহ পাঁচজনের মুখোমুখি বসে ছিলেন ফুলপরী। তদন্ত কমিটির সদস্যরাও সেই কক্ষে ছিলেন।
কথা প্রসঙ্গে ফুলপরীর বাবা বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অবধি আসার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, তাঁর ভ্যান নিয়ে বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার গিয়ে চরসাদীপুর এলাকায় আসেন। সেখানে নৌকায় এক ঘণ্টায় পদ্মা নদী পাড়ি দেন। এরপর ইজিবাইকে শিলাইদহ খেয়াঘাট থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আলাউদ্দিন নগর এলাকায় যান। সেখানে আরেকটি ইজিবাইকে ১০ কিলোমিটার গিয়ে কুষ্টিয়া শহরে চৌড়হাস পৌঁছান। সেখান থেকে বাসে করে ২৫ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্পাসে যান।
যেহেতু অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়েছে, তাই দীর্ঘসূত্রতা হওয়া উচিত নয়। এতে অভিযোগকারীর সময় যেমন যায়, সেই সঙ্গে হয়রানিও বাড়ে।
এভাবে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যায়। বাড়ি যেতেও চার ঘণ্টা লাগে। গত পাঁচ দিনে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে তিন দিন এসেছেন। প্রতিবারই অন্তত ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে। আসতে–যেতে মেয়েসহ তিনি নিজেও ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। যতবার আসছেন, তার আগের দিন ফোন করে জানানো হয় পরের দিন সকালে যেতে।
আতাউর বললেন, ‘প্রশাসন নিরাপত্তা দিয়ে এখানে রাখতে পারত। আমার আসা–যাওয়ায় কাজকর্ম বাদ দিয়ে আসতে হচ্ছে। এক দিন কাজ না করলে পেট চলে না। কাজ করবের পারতেছি না। তবে বিচারের জন্য কষ্ট হলেও আসছি। মেয়েকে নির্যাতন করা হয়েছে, তাই বিচারের জন্য আসতে হবে।’
দূরের পথ পাড়ি দিয়ে বারবার ক্যাম্পাসে আসা–যাওয়া প্রসঙ্গে ফুলপরী খাতুন বলেন, ‘ক্লান্তি ও অসুস্থবোধ থাকে। খুব ভালোও না, খুব খারাপও না। ন্যায়বিচারের দাবিতে যতবার আসা লাগে, ততবারই আসব। আমি চাই এই ক্যাম্পাসের সব শিক্ষার্থী যেন শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনা করতে পারেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়েছে, তাই দীর্ঘসূত্রতা হওয়া উচিত নয়। এতে অভিযোগকারীর সময় যেমন যায়, সেই সঙ্গে হয়রানিও বাড়ে। খরচও হয়। এতে মানসিক পীড়নও হয়। তাই এই অপরাধের দ্রুত বিচার হওয়া উচিত।
আবারও সাহস দেখালেন ফুলপরী
গতকাল বুধবার অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীসহ পাঁচজনকে ফুলপরীর মুখোমুখি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক রেবা মণ্ডলের কক্ষে বেলা ২টা ৫০ মিনিট থেকে ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ছিলেন তাঁরা। তদন্ত কমিটির বাকি সদস্যরাও সেখানে ছিলেন। ফুলপরীর বাবা আতাউর রহমান তখন ছিলেন অন্য কক্ষে।
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে ফুলপরী খাতুন পাবনার বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে আসেন। তিনি প্রথমে হল প্রাধ্যক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলেন। এরপর রেবা মণ্ডলের কক্ষে নেওয়া হয়। ওই কক্ষে আতাউর রহমান তাঁর মেয়েকে নিয়ে প্রবেশ করেন। কয়েক মিনিট পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী, তাবাসসুম ইসলামসহ অভিযুক্ত পাঁচজন ওই কক্ষে প্রবেশ করেন।
প্রায় এক ঘণ্টা পর বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে প্রথমে কক্ষ থেকে বের হন ফুলপরী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কে কী করেছেন এ বিষয়ে ম্যাম-স্যাররা জানতে চাইলেন। আমি সেটা বলেছি এবং তাঁদের চিনিয়ে দিয়েছি।’ এ সময় অভিযুক্তরা কিছু বলেছেন কি না, জানতে চাইলে ফুলপরী বলেন, ‘হ্যাঁ বলেছেন। তাঁরা বলছেন, “ফুলপরী, আমার সাথে এ রকম কোরো না। তোমার হাতে-পায়ে ধরে মাফ চাই।” অন্তরা (সানজিদা) আপু রিকোয়েস্ট করল। কিন্তু আমার সাথে যা যা হয়েছে, সেটাতে আমি অটল ছিলাম।’
ফুলপরী বলেন, ‘আমি তাঁদের বললাম, কেবল চার-পাঁচ দিন হলো ক্যাম্পাসে এসেছি, কিন্তু আপনারা আমাকে নিয়ে একটুও ভাবেন নাই। আমি এ বিষয়ে আপনাদের সাথে আর কথা বলতে চাই না। প্রশাসন এখন যে ব্যবস্থা নেয়, সেটাই ঠিক।’ পাঁচজনকে একসঙ্গে দেখে ভয় বা শঙ্কা কাজ করেছে কি না, জানতে চাইলেÑফুলপরী বলেন, ‘একদমই না। ভয় পাইনি। বরং তাঁদেরই কান্না কান্না ভাব ছিল। ফুলপরীর সঙ্গে কথা বলার সময় ওই কক্ষ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা-তাবাসসুমসহ পাঁচজন। এ সময় সানজিদা দ্রুত তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে একটি গাড়িতে উঠে চলে যান। সাংবাদিকেরা একাধিক প্রশ্ন করলেও তিনি নীরব ছিলেন। কারও কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। বাকি সদস্যরা একইভাবে বিভিন্ন দিকে দ্রুত চলে যান। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রেবা মণ্ডলসহ সব সদস্য গাড়িতে করে দ্রুত চলে যান।
১২ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন। ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা তাঁকে নির্যাতন করেন। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। এ ঘটনায় রিট হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।