দালাল ধরলেই সমাধান

অভিযোগমতে, দালালেরা পাসপোর্টপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা নেন। এর মধ্যে ২ হাজার ১০০ টাকা দিতে হয় কর্মকর্তাদের।

‌সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা কার্যালয়।ছ‌বি: সংগৃহীত

দালাল না ধরে নিজে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে ‘ঘাটে ঘাটে’ হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর ‘অযথা ভুল’ ধরে কর্মকর্তারা সেটি গ্রহণ করেন না। সংশোধন করে জমা দিলেও আবার আরেকটি ভুল ধরা হয়। এভাবে ভুল শুধরে আবেদন জমা দিতে দিনের পর দিন ছোটাছুটি করতে হয়।

তবে দালাল ধরে আবেদন করলে আবেদনপত্রে ‘বিশেষ চিহ্ন’ দেওয়া থাকে। এতে এক দিনেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ছবি তোলার সুযোগসহ দ্রুত পাসপোর্ট পান আবেদনকারীরা।

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা কার্যালয়ের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন অর্ধশতাধিক ‘ভুক্তভোগী’। তাঁদের দাবি, প্রতিদিন গড়ে ৮৫০ জন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। এর ৮৫ শতাংশ আবেদনকারীই দালালের শরণাপন্ন হন। এতে সরকারি ফির অতিরিক্ত খরচ হয় আড়াই হাজার টাকা। কোনো জটিলতা থাকলে পাসপোর্ট পেতে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন কার্যালয়টিতে গড়ে ১৮ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়।

নগরের দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে পাসপোর্ট কার্যালয়ের অবস্থান। এখানে সক্রিয় ৫০ থেকে ৬০ জন দালাল। যাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা দাবি করেন, শতাধিক ট্রাভেল এজেন্সি পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের আবেদনপত্র পূরণ করে থাকে।

দালাল ও ট্রাভেল এজেন্সির পূরণ করা আবেদনপত্র শনাক্তে বিশেষ চিহ্ন দেওয়া থাকে। এসব আবেদনকারী হয়রানি ছাড়াই পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে পারেন। চিহ্ন হিসাব করে দালাল ও এজেন্সিগুলো প্রতিদিনের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সন্ধ্যায় কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে ২ হাজার ১০০ টাকা কর্মকর্তাদের দিতে হয়।

তবে দৈনিক গড়ে ১৮ লাখ টাকা অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন সিলেট বিভাগীয় আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আবেদনপত্র পূরণ করতে গিয়ে অনেকে নাম, জন্মস্থান, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর লেখায় ভুল করছেন। যথাযথ তথ্য দিয়ে আবেদন না করার কারণে তাঁদের সংশোধন করতে বলা হয়ে থাকে। তাঁর দাবি, দালাল বা ট্রাভেল এজেন্সিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় না। আবেদনে কোনো বিশেষ চিহ্নও থাকে না।

নির্দিষ্ট আট অভিযোগ

পাসপোর্ট আবেদন করতে গিয়ে নির্দিষ্ট আটটি ভোগান্তির শিকার হতে হয় বলে উল্লেখ করেছেন আবেদনকারীরা। এসবের মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার, বিশেষ চিহ্ন ছাড়া আবেদন গ্রহণে অনীহা, দালালের মাধ্যমে আবেদন না করলে সব তথ্য ঠিক থাকলেও ইচ্ছাকৃত ভোগান্তিতে ফেলা, রোহিঙ্গা কি না, যাচাই করতে গিয়ে হয়রানি, দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ, সার্ভার ডাউনজনিত সমস্যা, নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পাওয়া।

শেষের তিনটি ছাড়া সব কটি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিভাগীয় আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে, যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে, তাঁদের রোহিঙ্গা কি না, সেই পরীক্ষা করা হয় না। কখনো কখনো সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা তাঁদের সুপারিশপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে লাইন ছাড়াও ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তোলার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে পুলিশ বা আনসার সদস্যরা এর জন্য টাকা নেন না।

গত বৃহস্পতিবার পাসপোর্ট কার্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, কার্যালয়ের তিনটি কক্ষে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলার কাজ চলছিল। এর বাইরে একাধিক কাউন্টারে পাসপোর্ট জমা নেওয়া ও প্রদান করা হচ্ছিল। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। কার্যালয়ের ভেতরে স্থানসংকট থাকায় কয়েক শ মানুষ কয়েকটি সারিতে বাইরে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কাউকে কাউকে মেঝেতে বসে পড়তে দেখা যায়।

তবে অধিকাংশ সময়ই পুলিশ ও আনসার সদস্যদের টাকা দিয়ে অনেকে সারিতে না দাঁড়িয়েই কাজ সারতে পারেন।

দেয়ালজুড়ে ক্ষোভ

পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে এসে বিড়ম্বনায় পড়া অনেকেই কার্যালয়ের ভেতরের দেয়ালে নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর হয়রানির কথা লিখে গেছেন। দোতলা ও নিচতলার প্রায় প্রতিটি দেয়ালে এসব ক্ষোভ, ভোগান্তি ও দুর্ভোগ-সংক্রান্ত লেখা চোখে পড়ে।

এসব লেখার মধ্যে রয়েছে, ‘ঘুষের আরেক নাম পাসপোর্ট অফিস’, ‘যাঁরা পাসপোর্ট অফিসে আসবেন, তাঁরা যেন অনেক ধৈর্যশীল হন’, ‘আজ বড়লোক হলে দালাল ধরে পাসপোর্ট বানাইতাম’, ‘লাইনে দাঁড় হতে হতে জীবন তামা তামা’, ‘সিরিয়ালে টোকেন সিস্টেম চালু করলে ভালো হয়’, ‘কাউকে শাস্তি দিতে চান, পাসপোর্ট অফিসে পাঠান’।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের অভিযোগ জানানোর জায়গা নেই। তাই দেয়ালে দেয়ালে তাঁদের অভিযোগ ও ক্ষোভের কথা লিখে রেখেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন দালাল চক্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়।’