নাটোরে বিএনপির কর্মসূচি মানেই হামলা, কখনো প্রকাশ্যে কখনো মুখোশ পরে
নাটোরে গত আট মাসে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির নয়টি দলীয় কর্মসূচি ছিল। প্রতিটি কর্মসূচিতেই হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে হামলা-সংঘর্ষে জড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কখনো হামলা হয়েছে চোরাগোপ্তাভাবে মুখোশ পরে। হামলার সময় মারপিটের পাশাপাশি বিএনপি নেতা-কর্মীদের টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, নাটোরে আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষ রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে পক্ষ দুটি। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে মোকাবিলা করার জন্য তাঁরা পাল্টা কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু হামলার সঙ্গে আওয়ামী লীগ জড়িত নয়।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছর বিএনপির প্রথম কর্মসূচি ছিল ১১ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন কেন্দ্রঘোষিত ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়। আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে প্রতিটি ইউনিয়নে শান্তি সমাবেশের ডাক দেয়। কর্মসূচি পালনের নামে তারা সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নে পদযাত্রা মঞ্চ দখল করে শান্তি সমাবেশ করে। একই দিন গুরুদাসপুর উপজেলায় পদযাত্রা থেকে ফেরার পথে বিএনপির দুই নেতার ওপর হামলা চালায়।
পরের কর্মসূচি ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পদযাত্রা কর্মসূচি ছিল। কর্মসূচি শুরুর আগে আওয়ামী লীগের মোটরসাইকেলবহর থেকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে উপর্যুপরি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বিএনপির কর্মীরা ভীতিকর পরিস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি পালন করেন।
বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বিএনপি ১ এপ্রিল সকালে সমাবেশের আয়োজন করে। আওয়ামী লীগও একই সময় বিএনপি কার্যালয়ের পাশেই শান্তি সমাবেশ করে। তাদের হামলায় বিএনপির অন্তত ২০ নেতা-কর্মী আহত হন বলে দলের নেতারা অভিযোগ করেন। ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলায় বিএনপির নির্ধারিত সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। ২৭ মে বিএনপি কেন্দ্রঘোষিত সমাবেশ পালনের উদ্যোগ নিলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সকালেই বস্তাভর্তি লাঠিসোঁটা নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। দুপুরে পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে সমাবেশ শুরু করলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের তোপের মুখে তড়িঘড়ি কর্মসূচি শেষ করে।
গত ৮ জুলাই শহরের একটি ওয়ার্ড কমিটি গঠনের জন্য সাংগঠনিক সভা ডাকা হয়েছিল জেলা বিএনপি কার্যালয়ে। এই সভা পণ্ড করতে কার্যালয়ে আসার পথে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। এর ১০ দিন পরেই পদযাত্রা প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। কার্যালয়ে ঢুকতে ও বের হতে দেননি তাঁরা।
আওয়ামী লীগের একজন বিশেষ ব্যক্তির ছত্রচ্ছায়ায় পদ-পদবিহীন কিছু সুযোগসন্ধানী রয়েছে। তারা চোরাগোপ্তা ও মুখোশ পরে হামলা করে আওয়ামী লীগের বদনাম ছাড়াচ্ছে।
১ আগস্ট কেন্দ্রঘোষিত জনসমাবেশ সফল করতে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব রহিম নেওয়াজ নিজ বাড়ি থেকে কার্যালয়ে আসছিলেন। সকাল ছয়টার সময় অল্প বয়সী কিছু তরুণ তাঁকে বেধড়ক পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়। এখনো তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন। হামলাকারীরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এই হামলার কথা জানিয়ে উল্লাস করেছেন। সর্বশেষ ১৯ আগস্ট বিএনপির পদযাত্রা প্রতিহত করে আওয়ামী লীগের একটি অংশের নেতা-কর্মীরা। মুখোশ পরিহিত দুর্বৃত্তরা হাঁসুয়া ও লাঠি নিয়ে নাটোর চিনিকল চত্বরে বিএনপির কর্মসূচিতে আসতে থাকা তিন নেতাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাফুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক (ভারপ্রাপ্ত) শহিদুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিক শিষ্টাচার তো থাকবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেটাও ভুলে গেছেন। নাটোরের সংসদ সদস্যসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা শহর ছেড়ে বিএনপি কার্যালয়ের ফটকে এসে সভা-সমাবেশ করছেন। এটা অতীতে কখনো ছিল না। তারা গায়ে পড়ে সংঘাত সৃষ্টি করতে চাইছে।
আমার সঙ্গে যারা থাকে, তাদের বর্তমানে পদ–পদবি দেওয়া হয়নি। তবে তারা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ত্যাগী নেতা–কর্মী। তারা দলের স্বার্থে বিএনপি–জামায়াতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী) রুহুল কুদ্দুস তালুকদার বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁরা কখনোই নাটোরে আওয়ামী লীগকে তাদের কার্যালয়ে আটকে রাখেননি। তারা স্বাধীনভাবে তাদের দলীয় কার্যালয়ে কর্মসূচি পালন করেছে। অথচ গত ১৪ বছরে বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থল কানাইখালীতে যেতে দেয় না। তারা পুলিশ ও মাস্তান দিয়ে প্রতিহত করে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম বিএনপির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা সহিংসতা করি না। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবেই প্রতিহত করি। এটা রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া কিছু নয়।’
তাহলে নানা আঙ্গিকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করছে কারা, তা জানতে চাইলে কারও নাম না উল্লেখ করে শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একজন বিশেষ ব্যক্তির ছত্রচ্ছায়ায় পদ-পদবিহীন কিছু সুযোগসন্ধানী রয়েছে। তারা চোরাগোপ্তা ও মুখোশ পরে হামলা করে আওয়ামী লীগের বদনাম ছাড়াচ্ছে। এর দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির সময় আমাদের অস্তিত্বহীন করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করি বলেই টিকে আছি। বিএনপি সন্ত্রাসী দল, তাই তারা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে ভয় পায়। এ ছাড়া তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বও রয়েছে। কিছু ঘটনা সে কারণেও হতে পারে।’
জানতে চাইলে সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলামের অভিযোগ সঠিক নয়। আমার সঙ্গে যারা থাকে, তাদের বর্তমানে পদ–পদবি দেওয়া হয়নি। তবে তারা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ত্যাগী নেতা–কর্মী। তারা দলের স্বার্থে বিএনপি–জামায়াতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে আমার সহযোগী হয়ে কাজ করে। এটা শরিফুল ইসলাম সহ্য করতে না পেরে তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। আমি মনোনয়নের জন্য এসব করছি না। দলকে শক্তিশালী করার জন্য করছি।’
নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কাউকে প্রশ্রয় দিই না। শান্তিপূর্ণ দলীয় কর্মসূচি পালনে পুলিশ সব সময় সহযোগিতা করে। বিএনপির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় না। তবে অনেক ঘটনা আমাদের অগোচরে ঘটে থাকে। অভিযোগ পেলে আমরা সেগুলোর ব্যাপারেও তৎপর হই।’