আগা বাকেরের বাকরখানি এখন বরিশালে

কাচের বাক্সে থরে থরে সাজানো বাকরখানিছবি: প্রথম আলো

বরিশালের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে জড়িয়ে আছে আগা বাকেরের নাম। তাঁর নামানুসারেই সেলিমাবাদ ও চন্দ্রদ্বীপের নাম হয়েছিল বাকেরগঞ্জ। সেটি ১৭৪১ সালের কথা। এরপর ১৭৯৭ সালে ইংরেজ শাসনামলে তাঁর নামেই বর্তমান বরিশাল জেলার নামকরণ করা হয়েছিল বাকেরগঞ্জ। ঐতিহাসিকদের দাবি, এই আগা বাকেরের নামানুসারেই নামকরণ হয়েছিল বাকরখানির। তবে বাকেরের পরগনা বরিশালে এই খাবারের কোনো প্রচলন ছিল না। কিন্তু এত বছর পর হঠাৎ করেই সেই বাকরখানি সুবাস ছড়াচ্ছে আগা বাকেরের বরিশালে। আর তা শহর থেকে দূরে কীর্তনখোলা নদীর পূর্বপাড়ে চর কাউয়া এলাকায়।

সম্প্রতি এক দুপুরে নগরের বান্দরোডের ডিসি ঘাট থেকে খেয়া পার হয়ে চর কাউয়া ঘাটে উঠে পাকা সড়ক ধরে পূর্ব দিকে যেতেই বাকরখানির মিষ্টি সৌরভ পাওয়া গেল। শীতের উত্তুরে বাতাসে উনুনে ভাজা মচমচে বাকরখানির সেই ম-ম গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। চর কাউয়া-লাহারহাট সড়কের দক্ষিণ দিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায়। কাচের বাক্সে থরে থরে সাজানো বাকরখানি।

পেছনে ছোট্ট একটি টিনশেড দোকানের ভেতরে বড় কাঠের টেবিলে দুজন ময়দার খামি নিয়ে গোলাকার বাকরখানি তৈরি করছেন। একজন তৈরি করা বাকরখানি টিনের ট্রেতে তুলে নিয়ে পাশেই গ্যাসের উনুনে ভাজতে দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর গরম বাদামি রঙের বাকরখানি বের করে আনছেন ট্রেসহ। ঢালছেন সামনের আরেকটি টেবিলের ওপরে। আরেকজন সেগুলো কাচের বাক্সে থরে থরে সাজাচ্ছেন। বেশ কয়েকজন ক্রেতাও গরম গরম লুফে নিচ্ছেন, কেউ কেউ দর করছেন।

পেশায় ইজিবাইকের চালক বাচ্চু মিয়া একটি গরম বাকরখানি হাতে নিয়ে ৫ টাকা দিয়ে বললেন, ‘নেলাম একটা।’ হাতে নিয়ে মুচমুচে বাকরখানিতে কামড় বসিয়ে বললেন, ‘অনেক স্বাদ। দুই মাস অইলো এই দোকান খুলছে হ্যারা। বানায় ভালো, তাই খুব চলে।’

বাকরখানি বরিশালের মানুষের কাছে খুব প্রসিদ্ধ খাবার নয়। পুরান ঢাকার প্রচলিত খাবার। খাবারটির নামের সঙ্গে যে আগা বাকেরের নাম জড়িয়ে আছে, সেটার ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় লেখক নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ধারণা করা হয়, মোগল সুবেদার মুর্শিদকুলি খানের পুত্র আগা বাকেরের নাম থেকেই এই বিশেষ ধরনের রুটির নামকরণ।’

কীর্তনখোলা তীরের চর কাউয়া বাজারে বাকরখানির এই কারখানায় বিক্রিবাট্টা আর কাজের চাপে ব্যস্ততা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। ফাঁকে ফাঁকে কথা হলো কীভাবে বাকরখানি এখানে এল? এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের একজন মো. খসরু (৩৫)। তিনি বললেন, তিনি একা নন, তাঁরা তিন বন্ধু মিলে এই প্রতিষ্ঠান করেছেন। মাস দুয়েক হলো এর যাত্রা শুরু। শুরুতে মাটির উনুনে বাকরখানি তৈরি করতেন। বিক্রির চাপ বেড়ে যাওয়ায় এনেছেন গ্যাসের বড় উনুন। প্রতিদিন তাঁরা অন্তত ১০০ কেজি বাকরখানি বিক্রি করেন। প্রতিটি বাকরখানি বিক্রি করেন ৫ টাকায়। আর কেজি বিক্রি করেন ২০০ টাকায়।

বরিশাল নগরের চর কাউয়া বাজারে বাকরখানি তৈরির কাজ করছেন এক কারিগর
ছবি: প্রথম আলো

খসরুর বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই গ্রামে। খসরু ২০০৪ সাল থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে গিয়ে কাজ নেন বাকরখানি কারখানায়। বিশেষ তালিম পান আলাউদ্দীন নামে পুরোনো এক কারিগরের কাছে। পরে ২০১৬ সালে আলাউদ্দীনের মেয়েকে বিয়ে করে থিতু হন কেরানীগঞ্জে। সেখানেই পরিচয় হয় মিরাজ গাজী (৩৫) ও শাকিল মিয়ার (৩৩) সঙ্গে। তাঁরাও দীর্ঘদিন কেরানীগঞ্জে বাকরখানি কারখানায় কাজ করতেন। তাঁদের দুজনের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের গোমা এলাকায়। পরিচয়ের সূত্র ধরে বন্ধুত্ব। কয়েক মাস আগে খসরু বেড়াতে যান বরিশালে দুই বন্ধুর বাড়িতে। এই সময় তাঁরা তিনজনে মিলে পরিকল্পনা করেন এখানে বাকরখানির কারখানা করার। এরপর তিনজনের যৌথ বিনিয়োগে গত অক্টোবরে চর কাউয়া বাজারে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে চালু করেন কারখানা।

মিরাজ বলেন, তাঁরা তিনজনই বাকরখানির কারিগর। তবে খসরুই মূল কাজটা করেন। প্রথমে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ কেজি বিক্রি হতো। এখন তা ১০০ কেজি পর্যন্ত বিক্রি হয়। প্রতিদিনই চাহিদা বাড়ছে। বরিশাল শহর থেকে অনেক ক্রেতা আসেন।

বরিশালের সঙ্গে সড়কপথে ভোলা, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ ও বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালীর বাউফল, কালাইয়াসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য চর কাউয়া বাজার থেকেই বাস বা অন্য বাহনে উঠতে হয়। এ জন্য প্রতিদিন এসব পথের হাজারো মানুষের যাতায়াত এই বাজার হয়ে। ফলে খুব দ্রুতই তিন বন্ধুর বাকরখানি সুবাস ছড়াচ্ছে এই অঞ্চলে।