‘কেন তারা আমার বুক খালি করল’

জুনায়েদ ফরাজি

২২ বছর বয়সের জুনায়েদ ফরাজি কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। অভাব-অনটনের সংসারে পড়ালেখা করা হয়নি। সংসারের বড় ছেলে হওয়ায় শিশু বয়স থেকেই শ্রমিকের কাজ শুরু করতে হয়েছে তাঁকে। ছোট দুই ভাই ও এক বোন তাঁর আয় করা টাকায় পড়ালেখা করছিল। ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বিলদেওয়ানিয়া গ্রামের শাহ আলম ফরাজির ছেলে জুনায়েদ। তিনি ঢাকার মিরপুর–১০ নম্বর এলাকায় একটি কম্পিউটারসামগ্রী বিক্রির দোকানে শ্রমিকের কাজ করতেন।

গ্রামবাসী ও জুনায়েদের পরিবার জানায়, শাহ আলম ফরাজি ও ডলি আক্তার দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের মধ্যে জুনায়েদ সবার বড়। শাহ আলম অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে স্ত্রী, সন্তান ও মায়ের ভরণপোষণ করছিলেন। অভাবের সংসার হওয়ায় জুনায়েদকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে শিশু বয়স থেকে। এলাকার একটি বিদ্যালয়ে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। এরপর কাজের সন্ধানে গাজীপুরে চলে যান। সেখানে কয়েক বছর জুতা বিক্রির দোকান কাজ করেন। এরপর ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার মিরপুর–১০ নম্বরে একটি কম্পিউটারসামগ্রী বিক্রির দোকানে কাজ নেন।

জুনায়েদের এক বোন জাজিরার একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে, এক ভাই নবম শ্রেণিতে এবং আরেক ভাই দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। তাদের পড়ালেখার জন্য প্রতি মাসে আট হাজার টাকা করে পাঠাতেন জুনায়েদ।

দোকানের মালিক সবুজ আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ১৯ জুলাই বিকেলে মিরপুরের অবস্থা খারাপ ছিল। পরিস্থিতি খারাপ থাকায় দোকান বন্ধ করে কর্মচারীরা বাসায় ফিরছিলেন। পথে জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নেওয়ার পরই তিনি মারা যান। ওই রাতে তিনি জুনায়েদের লাশ বাড়িতে পৌঁছে দেন।

গতকাল সোমবার বিলদেওয়ানিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বসতবাড়ির এক কোণে জুনায়েদকে কবর দেওয়া হয়েছে। কবরের পাশে মা ডলি আক্তার কান্না করছেন। বসতঘরে বসে দাদি রাবেয়া বেগম নাতির জন্য দোয়া পড়ছেন।

জুনায়েদের বোন ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘ভাইয়ার পাঠানো টাকা দিয়েই আমরা তিন ভাইবোন পড়ালেখা করতাম। ভাইয়া নেই, এখন আমাদের পড়ালেখার খরচ কে জোগান দেবে? কী অপরাধ ছিল আমার ভাইয়ার? এই বয়সে আমার ভাইয়াকে মরতে হলো কেন?’

ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে ডলি আক্তার বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। আমরা তো রাজনীতি বুঝি না। তাহলে আমার বুকের ধনকে কেন জীবন দিতে হলো? কেন তারা আমার বুক খালি করল?’

জুনায়েদের বাবা শাহ আলম ফরাজি বলেন, ‘আমরা এখন কী নিয়ে বাঁচব? ছেলে হত্যার বিচার কার কাছে চাইব?’

নড়িয়ার রাজনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু আলেম মাদবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুনায়েদ খুব অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরেছিল। ১৯ জুলাই রাতে তার মরদেহ গ্রামে আনা হয়। কোনো ঝামেলা যাতে না হয়, তাই রাতেই তার দাফন হয়। ওর এমন মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো না।’