ঈদের আগে থেকেই পাঙাল সমাজে আপ্যায়নের শুরু
ঈদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, আনন্দের ধরন প্রায় কাছাকাছি হলেও দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে ঈদ উদ্যাপনে আছে বৈচিত্র্য, পৃথক আচার-সংস্কৃতি। আর এই ফারাক পোশাক-আশাক, খানাপিনাতেই বেশি হয়ে থাকে। ‘পাঙাল’ হচ্ছে সে রকমই একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। এই মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর ঈদ উদ্যাপনের ক্ষেত্রেও আছে পরস্পরের সঙ্গে সম্প্রীতির, বন্ধনের আলাদা বৈশিষ্ট্য।
ঈদ শুরুর দুই-তিন দিন আগে থেকেই প্রতিবেশী ও মেহমানকে আপ্যায়ন করার মধ্য দিয়ে ঘরে ঘরে ঈদের খুশির বার্তা পৌঁছাতে থাকে। তেমনি ঈদের দিন পঞ্চায়েতের সবাই একটি বাড়িতে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে পরস্পরের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে থাকেন। পাঙাল হচ্ছে মণিপুরি জাতিগোষ্ঠীর মুসলিম শাখা, মণিপুরি মুসলমান। তারা ‘মীতৈ পাঙাল’ বা ‘খাঁ-ই বাঙাল’ নামেও পরিচিত। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে মীতৈ, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের সঙ্গে আছে এই পাঙাল সম্প্রদায়ের জনবসতি, বসবাস। বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (বামডো) ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৩৩টি গ্রামে মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল) সমাজের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১০ হাজার ৯৪৭।
মণিপুরি মুসলিম লেখক-গবেষক এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঙাল সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে পাঙালদের অনেক ক্ষেত্রে মিল থাকলেও কিছুটা ভিন্নতাও আছে। এই পার্থক্য হচ্ছে পোশাকে, আপ্যায়নের রীতিতে।
ঈদ উৎসবে পুরুষেরা বাঙালি মুসলিমদের মতো নিজেদের জন্য এবং আত্মীয়স্বজনকে উপহার দেওয়ার জন্য পাঞ্জাবি-পায়জামা, টুপি ইত্যাদি ক্রয় করে থাকেন। নারীরা সালোয়ার-কামিজ যেমন কিনে থাকেন, তেমনি ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি পোশাক ‘ফানেক’ (পরনের কাপড়), ‘খুদাই বা ইন্নাফি’ (ওড়না) শপিং মল, অনলাইন ও স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করেন। ঈদের দিন পাঙালদের নির্দিষ্ট ঈদগাহতে ঈদের জামাতে সমবেত হন তাঁরা। পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করেন, আনন্দ বিনিময় করেন।
খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের পৃথক কিছু প্রথা আছে। ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই পাঙাল বাড়ির ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি শুরু হয়। চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি গোলাকার এই পিঠা দুই ধরনের হয়ে থাকে। এর একটি বানানো হয় চালের গুঁড়ার সঙ্গে নানা পদের মসলা মিশিয়ে। এর নাম ‘মরোই তল’। এটি মাংস দিয়ে, নানা রকম ভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়ে থাকে। অপরটি বানানো হয় চালের গুঁড়ার সঙ্গে চিনি বা গুড় মিশিয়ে, এর নাম ‘চিনি তল’। পিঠার সঙ্গে সেমাই, নুডলস, শরবত ইত্যাদিরও আয়োজন থাকে। ঈদের এই সময় একে অপরের বাড়ি যান। তখন প্রতিবেশীকে এই পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এ ছাড়া মেহমান এলে তাঁদেরও এই পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। ঈদ উপলক্ষে বাবার বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়ি এই পিঠা পাঠানো হয়ে থাকে। মেয়েরাও তাঁদের বাড়ি থেকে বাবা-মায়ের জন্যও এই পিঠা তৈরি করে পাঠান।
পাঙাল সম্প্রদায়ের শিক্ষক, কবি ও লেখক সাজ্জাদুল হক স্বপন গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদ উদ্যাপনে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাঙালদের মিল থাকলেও কিছু ভিন্নতা রয়েছে। ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকেই পাঙাল সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে পিঠা মরোই তল ও চিনি তল তৈরি করা হয়। পিঠাগুলো আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া হয়। ঘরে মেহমানকে খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া ঈদের দিন পাঙালের অনেক পাঞ্চায়েত ঈদের জামাত শেষে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা একটা নির্দিষ্ট বাড়িতে করে থাকেন। এভাবে একে অন্যের সঙ্গে ঈদের আনন্দ শেয়ার ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়ে থাকে।’
কয়েকজন পাঙালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের সমাজের সব কটি পঞ্চায়েতে ঈদের দিন পঞ্চায়েতের যেকোনো একজনের বাড়িতে একসঙ্গে সবাই মিলে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার রেওয়াজ আছে। নানা কারণে প্রথাটি সবখানে প্রচলিত না থাকলেও কিছু কিছু পঞ্চায়েতে এখনো তা টিকে আছে। এই নিয়ম অনুযায়ী ঈদের জামাত শেষে পঞ্চায়েতের একজনের বাড়িতে একসঙ্গে সবাই মিলে খাওয়ার আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে সবার অংশগ্রহণ থাকে। পঞ্চায়েতের সবাই যাঁর যাঁর বাড়ি থেকে তৈরি খাবার নিয়ে আসেন। এই একসঙ্গে খাওয়ার প্রচলনটি হচ্ছে মূলত সবাই মিলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করা।
ঈদের দিন বিকেলে ছেলেরা বাঙালি মুসলিম তরুণদের মতোই পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং মেয়েরা মণিপুরি ঐতিহ্যের পোশাক পরে ঘুরতে বের হন। তরুণীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক; অর্থাৎ ফানেক, ব্লাউজ ও খুদাই পরে বান্ধবীদের বাসায় কিংবা দর্শনীয় স্থান দেখতে যান। পাঙাল বিবাহিত নারীরা ঈদের দিন বিকেলে কিংবা পরের দিন ঈদ উপলক্ষে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসেন। তাঁরা মা-বাবা, ভাই ও বোনদের জন্য উপহার ও ঐতিহ্যবাহী পিঠা নিয়ে আসেন। ঈদ উপলক্ষে দুই-তিন দিন বাবার বাড়ি কাটান। ঈদের তিন দিন পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনকে ঈদ উপলক্ষে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। এই রকম মেহমানদারি সব পাঙাল বাড়িতেই হয়ে থাকে।
পাঙালদের বড় ঈদের জামাতটি হয়ে থাকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের কান্দিগাঁওয়ে। এই ঈদগাহের নাম হচ্ছে কেজিবি ঈদগাহ (কান্দিগাঁও-ঘোড়ামারা-বন্দরগাঁও)। এই ঈদগাহে বাঙালি মুসলিম সমাজের কিছু অংশগ্রহণ থাকলেও বড় অংশটিই হচ্ছেন পাঙাল। এই ঈদগাহতে হাজার থেকে বারো শ পাঙাল জমায়েত হয়ে থাকেন। সাতটি মহল্লা মিলে এই ঈদগাহ। এখানে আদমপুর বাজার, কান্দিগাঁও, পশ্চিম কান্দিগাঁও, বন্দরগাঁও, ঘোড়ামারা ও নাজাতকোনা পাঙাল সম্প্রদায়ের লোকজন ঈদের নামাজ পড়ে থাকেন।