ঘিওরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভগ্নদশা
‘একটা ব্যবস্থা কইর্যা দ্যান’
২০০৯-১০ অর্থবছরে ঘিওরের মির্জাপুর নিন্দাপাড়া গ্রামে কালীগঙ্গা নদীর পশ্চিম পাশে প্রায় দুই একর জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়।
‘নদীতে বসতবাড়ি ভাইঙ্গ্যা যাওনের পর এইহানে আইস্যা আশ্রয় নিছি। ঘরের টিনের চালে মরিচ্যা ধইরা ফুটা হইয়্যা গ্যাছে। বৃষ্টির দিনে চাল দিয়্যা ঘরের ভেতর পানি পড়ে। শীতের দিনে পড়ে কুয়াশা। থাহনের অবস্থা না থাকলেও দুই ম্যায়া নিয়্যা খুব কষ্টে আছি। আমাগো একটা ব্যবস্থা কইর্যা দ্যান।’
এভাবে কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সিংজুরী ইউনিয়নের নিন্দাপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা পারভীন আক্তার। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ঘরের সামনে মাটির চুলায় রান্না করছিলেন পারভীন। শুধু পারভীন নন, আশ্রয়ণ প্রকল্পটির ঘরগুলো জরাজীর্ণ হওয়ায় কষ্টের মধ্যে বসবাস করছেন এখানকার সব বাসিন্দা।
দৌলতপুর উপজেলার আবুডাঙ্গা গ্রামের রাজমিস্ত্রির সহকারী আবদুল কাদেরের স্ত্রী পারভীন আক্তার। তিনি বলেন, নদীভাঙনে বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। এর পর থেকে দুই মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে ঠাঁই হয়েছে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারি অর্থায়নে ঘিওরের মির্জাপুর নিন্দাপাড়া গ্রামে কালীগঙ্গা নদীর পশ্চিম পাশে প্রায় দুই একর জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পে টিনের তৈরি পাঁচটি ব্যারাক (লম্বা ঘর) রয়েছে। প্রতিটি ব্যারাকে ১০টি ছোট কক্ষ রয়েছে।
প্রতিটি কক্ষের এক পাশে রয়েছে বারান্দা, অপর পাশে রয়েছে রান্নার ব্যবস্থা। একেকটি ভূমিহীন পরিবারকে একেকটি কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহারের জন্য প্রতিটি ব্যারাকের বাসিন্দাদের একটি অগভীর নলকূপ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতি পাঁচটি পরিবারের জন্য দুটি শৌচাগার ও একটি গোসলখানা নির্মাণ করে দেওয়া হয়।
গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, সারিবদ্ধ টিনের ঘর। অধিকাংশ ঘরের টিনের চালে মরিচা ধরে ফুটো হয়েছে। বৃষ্টির পানি ও কুয়াশা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘরের ভেতর চালের নিচে টাঙানো হয়েছে পলিথিন। ঘরের বেড়ার টিন, দরজা ও জানালার ভগ্নদশা। জরাজীর্ণ পাঁচটি ব্যারাকের প্রায় সব কটি কক্ষই বসবাসের অনুপযোগী।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা জানান, ব্যারাকের পাঁচটি নলকূপের তিনটিই অকেজো। দুটি নলকূপ নিজেদের অর্থে মেরামত করে ব্যবহার করছেন তাঁরা। শৌচাগারগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বাসিন্দাদের কেউ কেউ পলিথিনের বেড়া দিয়ে শৌচাগার তৈরি করে তা ব্যবহার করছেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো এত ছোট যে একটি কক্ষে তিনজনের বেশি বসবাস করা কঠিন। বসবাসকারীরা জানান, উপায় না পেয়ে তাঁদের এসব ঘরে বসবাস করতে হচ্ছে। এখানকার সবাই দিনমজুর। অর্থের অভাবে কক্ষগুলো মেরামত করতে পারছেন না তাঁরা। ৫০টি কক্ষের মধ্যে ৭ থেকে ৮টি কক্ষ বেশির ভাগ সময় খালি পড়ে থাকে। খালি কক্ষগুলোর বসবাসকারীরা অন্যত্র চলে গেছেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা গণেশ চন্দ্র সরকার বলেন, মেরামতের অভাবে পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে ঘরগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। ঘরের ভেতর বৃষ্টির পানি পড়ে। পলিথিন টাঙানো হলেও ঘরের ভেতর পানি পড়ে। আর্থিক সংকটে নিজ উদ্যোগে মেরামত করাতে পারছেন না।
অপর একটি কক্ষের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘টিনের চালা ফুটো হওয়ায় ঘরের ভেতর বৃষ্টির পানি ও কুয়াশা পড়ে। টিউবওয়েলও নষ্ট। নিজেগো ট্যাহায় দুইটা টিউবওয়েল মেরামত করছি। এহন এইহানে ঘরও ভাইঙ্গ্যা পড়ার দশা, আমাগো অন্য কোথাও যাওনের জায়গা নাই।’
এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের ভোগান্তির বিষয়ে স্থানীয় সিংজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুর রহমান বলেন, বৃষ্টি এলেই প্রতিটি কক্ষে পানি পড়ে। শৌচাগারগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা একেবারেই হতদরিদ্র। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ অবস্থা বাসিন্দাদের পক্ষে ঘরগুলো মেরামত করা সম্ভব নয়। সরকারি অনুদানে ঘরগুলো মেরামত করা গেলে এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ কমবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো অনেক আগে নির্মাণ করা হয়েছে। ঘরগুলো মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এরপর সরকারি অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে ঘরগুলো মেরামত করা হবে।