‘আমার মেয়ে বৃষ্টি। ওকে আমার কাছে এনে দাও। আমি ওর মুখটা দেখব।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন বিউটি বেগম। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজন–প্রতিবেশীরা নির্বাক। মেয়ের লাশ পড়ে আছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। সেখানে মেয়ের লাশ নিতে দুই দিন ধরে যুদ্ধ করে চলেছেন বাবা সবুজ শেখ।
রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনে সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামের একজন নিহত হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ও তাঁর চাকরিক্ষেত্রে তিনি অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন। তবে তাঁর জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও চাকরির জন্মবৃত্তান্তে নামের ক্ষেত্রে কোনোটিতে বৃষ্টি খাতুন আবার কোনোটিতে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামটা আছে। এসব নথিতে বাবার নামের জায়গায় শাবলুল আলম ও মায়ের নাম বিউটি বেগম লেখা। তবে চাকরির জন্মবৃত্তান্তে মায়ের নাম অপর্ণা শাস্ত্রী লেখা।
বৃষ্টি খাতুন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বনগ্রাম পশ্চিমপাড়ার শাবলুল আলম ওরফে সবুজ শেখের মেয়ে। তাঁরা তিন বোন। বৃষ্টি সবার বড়। মেজ বোনের নাম ঝর্ণা খাতুন ও ছোট বোনের নাম বর্ষা খাতুন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বৃষ্টির আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার খবর আসে। মৃত্যুর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও নাম–সংক্রান্ত জটিলতায় লাশ বুঝে পাননি বাবা। তাঁর পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা হবে না বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এদিকে মেয়ের লাশ না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মা বিউটি বেগম।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়েছেন গ্রামের স্কুলে। উচ্চমাধ্যমিক পড়েছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক শেষ করেছেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সরকারি চাকরির কোচিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
শনিবার বিকেলে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে প্রতিবেশী ও স্বজনের ভিড়। ঘরের ভেতরে বসে আছেন বিউটি বেগম। তিনি কেঁদেই যাচ্ছেন। স্বজনেরা বলছেন, দুই দিন ধরে মেয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। মেয়ের পাওয়া ক্রেস্ট ও ছবি বুকে ধরে কাঁদছেন। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে উঠছেন, ‘আমার মেয়ে কই, তাঁকে আমার কাছে এনে দাও। আমি তাঁর মুখটা দেখব।’
ছোট মেয়ে বর্ষা ও প্রতিবেশীরা বিউটি বেগমকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আহাজারি করতে করতে বলছেন, ‘আমার মেয়ে, ওর নাম বৃষ্টি’ বলে মূর্ছা যাচ্ছেন। বাড়িতে আসা সাংবাদিকদের কাছে তিনি আকুতি জানাচ্ছেন, ‘আমার মেয়ের লাশ ফেরত পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হাত পাতছি।’
বিউটি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, অক্টোবর মাসে একবার বাড়িতে এসেছিল বৃষ্টি। ব্যাংক লোন নিতে। অভিশ্রুতি নামের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিউটি বেগম বলেন, ‘ঢাকায় সাংবাদিকদের নানা হুমকিধমকি পেতে হয়। এ জন্য এই নামে (অভিশ্রুতি) চলত। এ ছাড়া কিছু বিষয় ছিল। তবে পরিষ্কার করে বৃষ্টি কিছু জানায়নি। সে বলেছিল, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ছোট মেয়ে বর্ষা খাতুন জানায়, গত বৃহস্পতিবার দুপুরেও মায়ের সঙ্গে বৃষ্টির শেষবার মুঠোফোনে কথা হয়।
বৃষ্টির চাচা জোয়াদ আলী বলেন, গত ঈদেও বৃষ্টি বাড়িতে এসেছিল। সবুজের তিন মেয়ের মধ্যে বৃষ্টি সবার বড়। মেজ মেয়ে ঝর্ণা রাজবাড়ী সরকারি কলেজের ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে বর্ষা মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে থাকে। সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা ঢাকায় চাকরি করলেও হোস্টেলে থাকত বৃষ্টি।
প্রতিবেশী মাসুদ রানা জানান, তাঁর মেয়ের সঙ্গে বৃষ্টি পড়াশোনা করত। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে।