‘বাঁইচে থাকা যে কত কষ্টের, তা আমার মতোন আর কেউ বুঝবে না’
চার বছর ধরে রাস্তার পাশে খাস জমিতে ঝুপড়ি ঘর বেঁধে শিশুসন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের জোড়শিং গ্রামের স্বপ্না বেগম। নিচু দোচালা ঘরটির গা ঘেঁষে বয়ে গেছে একটি খাল। ভাঙাচোরা ঘরটির আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। কয়েকটি কাঁথা ও বালিশই সম্বল। ঘরটির মধ্যেই চলে রান্না ও ঘুম। মাটিতে কাঁথা-কাপড় বিছিয়ে কোনোরকমে রাত কাটান তাঁরা। স্বপ্নার স্বামী আবদুর রউফ গাজী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এখানে আর তাঁদের খোঁজ নিতেও আসেন না।
গত বুধবার দুপুরে প্রচণ্ড রোদে খালের পাড় থেকে কাদামাটি তুলে ঘরের ভিত ঠিক করছিলেন স্বপ্না বেগম (৪২)। এ কাজে তাঁর সহযোগী ৯ বছরের মেয়ে মরিয়ম। নিচু ঘরটির মেঝেতে তখন থালায় ভাত নিয়ে বসে ছিলেন ছোট দুই ছেলে সাত বছরের আরিফুল ও পাঁচ বছরের রকিবুল। ঘরের সামনে অচেনা মানুষ দেখে এগিয়ে আসেন স্বপ্না বেগম। এ প্রতিনিধিকে জানান, তাঁর বড় ছেলে মেহেদী হাসানের (১৪) সামান্য রোজগারে সন্তানদের নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। কোনো দিন অর্ধাহারে, কোনো দিন থাকতে হয় অনাহারে।
জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বপ্না বেগম বলেন, ‘নিজির গতর খাটায়ে চার ছাওয়াল-মাইয়ের খাবার জোগাড় করতি হয়েছে। কখনো রাস্তার কাজে, কখনো মানুষির বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, আবার কখনো গাঙে জাল টানতি হয়। শরিলি আর কুলাই ওঠে না। অসুখবিসুখ লাইগেই আছে। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতি পারি না। বড় ছেলেটারে নদীতে পাঠাইছি। কয়দিন ধরে তার সামান্য রোজগারেই নুন-ভাত জোটে। বাঁইচে থাকা যে কত কষ্টের, তা আমার মতোন আর কেউ বুঝবে না।’
বলতে বলতে গলা ধরে আসে স্বপ্নার। মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায় ছোট ছেলেমেয়েরা। শিশুরা অপলক তাকিয়ে আছে। আঁচলে চোখের পানি মুছে স্বপ্না বলেন, ‘একখান ঘরের জন্যি অনেকের কাছে গেছি। সবাই খালি আশ্বাস দেয়, ঘর দেয় না। চার বছর ধইরে রাস্তার পাশে পইড়ে আছি। আয়রোজগার নাই। ছোট ছাওয়াল দুটো বুঝতি চায় না। খালি এইটা-সেইটা খাইতে চায়। ভালো খাবার ছাওয়াল-মাইয়েগের কপালে নাই। মাঝেমধ্যি মনে হয়, গাঙে ডুইবে যাই। কিন্তু চার ছাওয়াল-মাইয়ের মুখির দিকি তাকায়ে তা করতি পারিনে।’
পাশের শাকবাড়িয়া নদী পার হলেই সুন্দরবন। সেখানে অন্যের ডিঙি নৌকায় করে মাছ ধরতে যান স্বপ্না বেগমের বড় ছেলে মেহেদী। যে বয়সে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, সে বয়সে মায়ের অসুস্থতার কারণে সব দায়িত্ব পড়েছে তার কাঁধে। নদীর পাড়েই দেখা হয় কিশোর মেহেদীর সঙ্গে। মেহেদী বলে, ‘খুব ভোরে গাঙে আসি। মানুষের সাথে ডিঙি নৌকায় বাদার খালে মাছ-কাঁকড়া ধইরে কোনো দিন দুই শ, কোনো দিন তিন শ টাকা পাই। যেদিন কেউ নৌকায় না নেয়, সেদিন নদীতে জাল টেনে বাগদা চিংড়ির রেণু ধরি। কামাই (রোজগার) একটু কম হয়। সেদিনটা অনেক কষ্টে যায় আমাগের।’
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ছোটবেলায় মা মারা যান স্বপ্নার। তারপর বাবা আরেকটি বিয়ে করলে স্বপ্নার ঠাঁই হয় নানাবাড়িতে। সেখানেই বেড়ে ওঠেন স্বপ্না। ১৫ বছর আগে বিয়ে হয় আবদুর রউফের সঙ্গে। সন্তানদের জন্মের পর নানাবাড়ি থেকে চলে এসে রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। স্বপ্নার স্বামী রউফ গাজী আরেকটি বিয়ে করে চলে যান। সেই থেকে সন্তানদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবন যাপন করছেন স্বপ্না।
ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে স্বপ্নার কষ্ট দেখতি না পাইরে মাঝেমধ্যি চাল-ডাল যা পারি, দেই। দুর্মূল্যের বাজারে গ্রামের সব মানষির টানাটানির মধ্যি দিন কাটাতি হয়। এর মধ্যি মন চালিও সব সময় সহযোগিতা করতি পারিনে।
স্বপ্নার প্রতিবেশী আমেনা খাতুন বলেন, ‘ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে স্বপ্নার কষ্ট দেখতি না পাইরে মাঝেমধ্যি চাল-ডাল যা পারি, দেই। দুর্মূল্যের বাজারে গ্রামের সব মানষির টানাটানির মধ্যি দিন কাটাতি হয়। এর মধ্যি মন চালিও সব সময় সহযোগিতা করতি পারিনে।’
স্বপ্নার ঝুপড়ি ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই বলে জানান জোড়শিং গ্রামের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন। তিনি আরও বলেন, স্বপ্নার বাচ্চারা বাড়িতে না খেয়ে থাকলেও খবর নেওয়ার কেউ নেই। সরকারি কিংবা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হতো। ছেলে–মেয়েরা পড়াশোনার নিশ্চয়তা পেত।
স্থানীয় দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বলেন, পরিবারটির খাওয়ার কষ্টের সঙ্গে বড় সমস্যা ঘরের। তাঁদের থাকার স্থায়ী ব্যবস্থা করতে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। অন্যান্য সরকারি সহায়তার পাশাপাশি এবার ভিজিডির একটি কার্ড করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।