বাতাসে দুলে উঠছে লাল শাপলা, যেন স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে
ব্যস্ত পাকা সড়কের পাশে জলাশয়জুড়ে (খাড়ি) মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে টুকটুকে লাল শাপলা। ভেসে থাকা পাতার গাঢ় সবুজ রঙের গালিচায় ঢেকে গেছে টলমলে পানি। আর সেখানে সকালের মিঠে রোদ এসে লুটোপুটি খেতে চাইলেও গাছের শাখার বাধা পেয়ে সব ফুল ছুঁতে পারছে না। হিম হিম বাতাসে দুলে উঠছে ফুলগুলো; যেন জানান দিচ্ছে, হে পথিক, স্বাগত। হেমন্তের সকালে আলো–ছায়া আর শীতমাখা বাতাসের অনুষঙ্গে মোহনীয় সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়েছে জলাশয়টি।
এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায়। গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের ছোট মহেশপুর গ্রামের বিরামপুর-নবাবগঞ্জ আঞ্চলিক পাকা সড়কসংলগ্ন জলাশয়টির ভাসমান শাপলার নজরকাড়া সৌন্দর্যে চোখ ফেরানো দায়। ক্ষণিকের জন্য হলেও পথচারীরা সেখানে জিরিয়ে নেন, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন লাল লাল শাপলার দিকে। কেউ কেউ ফুলের সঙ্গে নিজেকে বন্দী করেন মুঠোফোনের ক্যামেরায়। কেউ আবার সোজা চলে যান জলাশয়ের মধ্যে স্থাপিত বাঁশ-কাঠের টংয়ের ওপর। সিঁড়ি বেয়ে সেখানে গিয়ে আরও চমৎকারভাবে শাপলার সৌন্দর্য উপভোগের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন দর্শনার্থীরা।
তবে কয়েক বছর আগেও জলাশয়টি ছিল সাধারণ একটি স্থান। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে গ্রামটির ৩৭ তরুণ-যুবক মিলে সেখানে শাপলা রোপণের কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁদের কয়েকজন হলেন নাসিরুল ইসলাম, রিমন, রাফিউল, রাশিদুল, আজিজুল, মুস্তাহিদ, রাব্বি, ওয়ারেস, মারুফ, সোহেল, সামিউল, মনোয়ার, আবদুল কাদের প্রমুখ। তাঁদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। বাকিদের কেউ কেউ চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী। তাঁদের দাবি, প্রকৃতিতে শাপলার সৌন্দর্যকে টিকিয়ে রাখতেই এমন উদ্যোগের কথা ভেবেছিলেন। তাই পাশের আশুড়ার বিল থেকে শাপলার সাতটি চারা এনে জলাশয়টিতে রোপণ করেন। পরিচর্যা আর যত্নে বেড়ে উঠে পুরো জলাশয়ে ছড়িয়েছে শাপলা। দুই শতাধিক শাপলার এ জলাশয়ের নাম তাঁরা দিয়েছেন ‘নিশিকুঞ্জ’।
পড়ন্ত বিকেলে গ্রামটির তরুণ-যুবকেরা জলাশয়ে স্থাপিত টংয়ে জমান গল্পের আসর। হেমন্তের শীতল হাওয়া গায়ে মেখে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। কেউ কেউ গান করেন। কেউ আবার সেখানে বসেই বুঁদ হয়ে হারিয়ে যান জলাশয়ের পানিতে। মনোযোগ দিলেই খুঁজে পান, টংয়ের নিচে পানিতে চলছে দেশীয় প্রজাতির মাছের ডুবসাঁতার। মাছের আনাগোনায় দুলে উঠছে শাপলাগুলোও।
গত শুক্রবার বিকেলে সেখানে দেখা যায়, পানির ওপর কাঠের তৈরি টংয়ে গোল হয়ে বসে কয়েকজন তরুণ–যুবক আড্ডা দিচ্ছেন। পথচারীরা ভ্যান ও মোটরসাইকেল থেকে নেমে শাপলা ফুল দেখছেন। তাঁদের কেউ কেউ সিঁড়ি বেয়ে টংয়ের ওপর উঠে চারদিকে জলে ভাসা শাপলা দেখছেন।
টংয়ের ওপর খোশগল্পে ব্যস্ত ছিলেন নিশিকুঞ্জের অন্যতম উদ্যোক্তা সাজেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জলাশয়টিতে শাপলা লাগানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রায় হারাতে বসা ফুলটিকে বাঁচিয়ে রেখে আমাদের গ্রামের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা। আর এই শাপলার কারণে যেন আমাদের গ্রামকে মানুষ দূর থেকে চেনেন। গ্রাম থেকে ফিরে গিয়ে যেন বলতে পারেন—সুন্দর একটা গ্রাম দেখে এলাম। আমাদের মনে সৎ উদ্দেশ্য ছিল, আমরা সেটি করতে পেরেছি।’
আরেক উদ্যোক্তা রাফিউল ইসলাম বলেন, ‘এই শাপলা ফুলকে প্রকৃতির মধ্যে ধরে রাখতে গাছগুলো সংরক্ষণ করছি। আর এ সৌন্দর্যের মাধ্যমে এলাকার তরুণ-যুবকেরা যেন ভালো পথ ছাড়া কোনো খারাপ পথে না যায়, সেই কাজই করছি।’
অবসর মিললেই জলাশয়টির আশপাশে সময় কাটান শিক্ষার্থী নাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি এ গ্রামেই। এখানে আমরা অবসর সময়টা পার করি। এমন সুন্দর পরিবেশের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক বজায় রাখা যায়।’
শুধু গ্রামবাসীই নন, বাইরের দর্শনার্থীরাও জলাশয়টির সৌন্দর্যে বিমোহিত। খবর শুনে পাশের উপজেলা হাকিমপুর থেকে জলাশয়টি দেখতে যান রুশদী আহমেদ বিশ্বাস নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘এখানকার সৌন্দর্য দেখে মানুষ আটকে যায়। আমিও এসে আটকে গেছি।’
স্থানীয় তরুণ ও যুবকদের উদ্যোগে পরিবেশে জীববৈচিত্র্যে রক্ষার এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর। নবাবগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হানিফ উদ্দিন জানান, শাপলা ফুল জীববৈচিত্র্যের এক অংশ। উপজেলাটিতে বিভিন্ন জলাশয়ের নাব্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে শাপলার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। ছোট মহেশপুর গ্রামের যুবকেরা শাপলার সংরক্ষণ ও বিস্তারের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটি প্রশংসার দাবি রাখে।