সিরাজগঞ্জে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট
১২০ কোটির প্রকল্পে ৪২ কোটি টাকার অনিয়ম, নিরীক্ষা আপত্তি নিষ্পত্তি হচ্ছে না
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে স্থাপন করা হয়েছে বেগম আমিনা মনসুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। প্রায় আড়াই বছর আগে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এর নির্মাণকাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এই প্রকল্পে ৪২ কোটি ৫২ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬০ টাকা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনে অচল যন্ত্রপাতি স্থাপন, নিম্নমানের কাঠের আসবাবপত্র সরবরাহ, চায়নিজ রেস্তোরাঁর ক্রয়–বিক্রয় রসিদে ফল, কেক ও মিষ্টির ভাউচার তৈরির কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো প্রকার বই সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন ও উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই বাজারদরের চেয়ে অস্বাভাবিক মূল্যে যন্ত্রপাতি কেনার নানা অনিয়মের বর্ণনা রয়েছে। ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি বাণিজ্যিক নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নিরীক্ষা ও হিসাব কর্মকর্তা বিমল কৃষ্ণ মৃধা এই বিস্তর অনিয়মের চিত্র তুলে এনে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ২০১৬ সালে পাঁচ একর জমির ওপর বেগম আমিনা মনসুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এ সময়ের মধ্যে ছয়তলা একাডেমিক ভবন, শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি আবাস, অধ্যক্ষের বাসভবনসহ আরও বেশ কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন।
নিরীক্ষা অধিদপ্তর প্রকল্পটির ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের কাজের ওপর ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি নিরীক্ষা কাজ পরিচালনা করে। নিরীক্ষায় ৪২ কোটি ৫২ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬০ টাকা অনিয়মের চিত্র ফুটে ওঠে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) অনুমোদিত দরের অতিরিক্ত দরে পিপিআর ২০০৮–এর বিধি লঙ্ঘন করে উন্মুক্ত দরপত্রের (ওটিএম) পরিবর্তে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) মাধ্যমে ৩ কোটি ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪০৭ টাকার নিম্নমানের আসবাবপত্র ফ্যানকন ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা বিধি সম্মত নয়। এ কারণে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে চুক্তিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে যন্ত্রপাতি স্থাপন ও সন্তোষজনকভাবে পরিচালনা ছাড়াই শতভাগ বিল পরিশোধ করায় ২৪ কোটি ৫১ লাখ ১৮ হাজার টাকা ও যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ আরও ১৪ কোটি ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ২৫০ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যয় করা হয়েছে, যা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দায়ী (প্রকল্প পরিচালক) ব্যক্তির কাছ থেকে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া কম্পিউটার ক্রয় বাবদ ১৭ লাখ ৮ হাজার ৯৯৫ টাকা, বই সরবরাহ না করেই ২১ লাখ ১৮ হাজার ৭০৫ টাকা, সম্মানী বাবদ ১১ লাখ ১৪ হাজার ৫৫০ টাকা, নকল ক্যাশ মেমো দেখিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬৫২ টাকা ও পরিশোধিত বিভিন্ন বিল হতে ভ্যাট কর্তন না করায় ৬ লাখ ২৯ হাজার ১ টাকা সরকারের ক্ষতি হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করা আবশ্যক বলে সুপারিশ করেছেন তৎকালীন নিরীক্ষা ও হিসাব কর্মকর্তা বিমল কৃষ্ণ মৃধা।
নিরীক্ষা অধিদপ্তর প্রকল্পটির ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের কাজের ওপর ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি নিরীক্ষা কাজ পরিচালনা করে। নিরীক্ষায় ৪২ কোটি ৫২ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬০ টাকা অনিয়মের চিত্র ফুটে ওঠে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জুনে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও উত্থাপিত নিরীক্ষা আপত্তিগুলোর নিষ্পত্তি এখনো শেষ হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো তোড়জোড়ও দেখা যাচ্ছে না। নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, চুক্তিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১০০ ভাগ বিল পরিশোধ করা বিধিসম্মত হয়নি।
এ বিষয়ে বাণিজ্যিক নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন নিরীক্ষা ও হিসাব কর্মকর্তা বিমল কৃষ্ণ মৃধা বলেন, ‘আমি ওই প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছি। বিভিন্ন অনিয়ম সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর এই প্রতিষ্ঠানের আর কোনো নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি হয়নি। প্রতিবেদনে আমি জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ সরকারি অর্থ আদায়ের সুপারিশ করেছিলাম।’
বেগম আমিনা মনসুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বস্ত্র অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) শাহাদাত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বর্তমানে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্বে রয়েছি। কাজীপুরের ওই প্রকল্প ২০২১ সালের জুনেই শেষ হয়েছে। পরবর্তী বছর আমার বিরুদ্ধে বেশ কিছু নিরীক্ষা আপত্তি দেওয়া হয়েছিল। যদিও এগুলো সব মিথ্যা। তবুও আমি সেগুলোর জবাবও দিয়েছি। তা ছাড়া নিরীক্ষা কর্মকর্তার কাজই তো নিরীক্ষা আপত্তি দেওয়া। এটা সব সরকারি প্রতিষ্ঠানেই হয়।’
প্রতিষ্ঠানের কিছু যন্ত্রপাতি মাঝেমধ্যেই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এগুলো মেরামত করেই আমাদের চলতে হচ্ছে।নাসির উদ্দিন, অধ্যক্ষ, বেগম আমিনা মনসুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট
টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ ও বর্তমান নওগাঁ শহীদ কামরুজ্জামান টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম ও অসংগতি নিয়ে কথা বলায় প্রকল্প পরিচালক শাহাদাত হোসেন তদবির করে আমাকে বদলি করেছিল। অথচ প্রকল্পের প্রতি স্তরে অনিয়ম করলেও তাঁর এখনো কিছুই হয়নি।’
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অধ্যক্ষ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্প থাকাকালীন সময়ে আমি ছিলাম না। গত বছরের জুলাই মাসে যোগদান করেছি। তবে প্রতিষ্ঠানের কিছু যন্ত্রপাতি মাঝেমধ্যেই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এগুলো মেরামত করেই আমাদের চলতে হচ্ছে।’