২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পথে পথে চাঁদাবাজি, ভোলার তরমুজচাষি ও ব্যবসায়ীরা বিপাকে

ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে এবার তরমুজের ভালো ফলন হয়েছেফাইল ছবি: প্রথম আলো

ভোলায় চলতি বছর দেড় হাজার হেক্টর জমিতে প্রায়  ৭৫ হাজার মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে। এর বেশির ভাগই যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু জেলা থেকে পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে চাষি ও ব্যবসায়ীরা নৌপথে পদে পদে চাঁদাবাজির সম্মুখীন হচ্ছেন।

চাষি ও ব্যাপারীরা বলছেন, ভোলা থেকে সাধারণত দুভাবে তরমুজ পরিবহন করতে হয়। প্রথমত, ট্রলারে তরমুজ নিয়ে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও বরিশালে নিয়ে ট্রাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। এ ছাড়া সরাসরি ট্রাকে তরমুজ তুলে নৌযানে পারাপার করা। কিন্তু পরিবহন করতে গিয়ে নৌপথের বিভিন্ন ঘাটে নির্দিষ্ট হারে তাঁদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। অন্যথায় নির্দিষ্ট সময়ে মালামাল পার করা যায় না। কাঁচামাল হওয়ায় তাঁরা চাঁদা দিতে বাধ্য হন।

ইলিশা ফেরিঘাটে এলেই কাঁচামালের গাড়ি থেকে ইজারাদারের লোকজন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা চাঁদা নেন। অথচ ঘাটের ইজারা ৬০-৭০ টাকা। এ নিয়ে প্রতিদিন ট্রাকচালকদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
বদরুদ্দিন, ট্রাকচালক

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোলায় এবার প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ করা হয়। সদর উপজেলার ভেলুমিয়া, ভেদুরিয়া; বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর; চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর; লালমোহন উপজেলার চরকচুয়া, চর শাহজালালসহ তেঁতুলিয়া নদীতে জেগে ওঠা চরে তরমুজের আবাদ করা হয়। এসব খেতে প্রায় ৭৫ হাজার মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। এসব তরমুজ ট্রলারে অন্য জেলায় যায়। ট্রলার ছাড়া খেত থেকে সরাসরি ট্রাকে তরমুজ তুলে ফেরি ও কার্নিভ্যাল ক্রুজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়।

নদীতে ট্রলার থামিয়ে চাঁদাবাজি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তেঁতুলিয়া ও মেঘনা নদীর সংযোগস্থল ইলিশা নদীর জোড়খাল এলাকায় ট্রলার ও স্পিডবোট দিয়ে তরমুজের ট্রলার থামিয়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন রাজাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খানের লোকজন। গঙ্গাপুর ও ভেলুমিয়ার একাধিক চাষি ও ব্যাপারী এ অভিযোগ করেন।

ভোলার তরমুজচাষিরা ফেরিঘাটে ও নদীতে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। গত সোমবার ভোলার ইলিশা ঘাটে
ছবি: প্রথম আলো

রাজাপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি দুলাল ঢ়াড়ি বলেন, শুধু তরমুজের ট্রলার না; ইলিশা-রাজাপুরের উত্তরে মেঘনায় যত নৌযান চলাচল করে, সবার থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। তাঁরা ঢাকা থেকে একটি সংগঠনের অনুমোদন এনে রাজাপুরে ২৩ সদস্যের একটি কমিটি করেছে। ওই সংগঠনের সভাপতি মিজানুর রহমান। তাঁর (মিজানুর) ভাইসহ এলাকার লোকজন ওই সংগঠনের নামে ইচ্ছেমতো চাঁদাবাজি করছেন।

তবে মিজানুর রহমান খান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মূলত বাইরের জেলা থেকে আসা কার্গো জাহাজের পাইলট পরিবর্তন করে তাঁরা পাইলট দেন। পাইলটেরাই সংগঠনের সদস্য। তরমুজের ট্রলার থেকে তাঁদের চাঁদা তোলার কথা না। এমনটি হলে তিনি বন্ধ করার চেষ্টা করবেন।

আরও পড়ুন

ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি

ভোলার ইলিশা ফেরিঘাট থেকে লক্ষ্মীপুরে প্রতিদিন পাঁচটি ফেরি চলাচল করে। এ ছাড়া কার্নিভ্যাল ক্রুজ ও ওয়েভ নামে দুটি গাড়িবাহী নৌযান ঢাকায় যায়। এতে সরাসরি তরমুজের ট্রাক ঢাকায় নেওয়া হয়। কিন্তু ঘাটে সিরিয়াল আগে দেওয়ার কথা বলে চাঁদা নেন ইজারাদার ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

ট্রাকচালক ও ব্যাপারীদের অভিযোগ, ঘাটে সিরিয়াল দিয়ে তদবির না করলে ডাক আসে না। কেউ ঘাটে এসে ইজারাদারের লোকজনকে টাকা দিলে মুহূর্তেই পার হয়ে যেতে পারেন। ঘাটে ভাড়ার নির্দিষ্ট তালিকা না থাকায় তাঁরা কিছু বলতেও পারেন না।

ট্রলার ছাড়াও খেত থেকে সরাসরি ট্রাকে তরমুজ তুলে ফেরি ও কার্নিভ্যাল ক্রুজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা ঘাটের অদূরে
ছবি: প্রথম আলো

চরফ্যাশনের দক্ষিণ আইচা এলাকার চাষি হোসেন মাতব্বর গত সোমবার ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় কার্নিভ্যাল ওয়েভে এক ট্রাক তরমুজ ঢাকায় পাঠান। যদিও ৯ দিন আগে তাঁর সাড়ে ১৪ হাজার টাকা লেগেছে। হোসেন মাতব্বর বলেন, সোমবার একই ভাড়ায় যেতে চাইলে কার্নিভ্যালের কর্মচারীরা ৬-৭ দিন অপেক্ষা করতে বলেন। এখন যেতে গেলে ২০ হাজার টাকা চান। পচে তরমুজ নষ্ট হওয়ার ভয়ে বাধ্য হয়ে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন।  

ট্রাকচালক ও ব্যাপারীরা জানান, ঘাটের ইজারাদার ইলিশা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ইউসুফ পাটওয়ারী, সুমন ও বাবুল কাঁচামালের গাড়ি থেকে চাঁদা তোলেন। এ জন্য তাঁরা কোনো রসিদ দেন না। প্রতিবাদ করলে সিরিয়ালের ভয় দেখিয়ে ৬-৭ দিন পরে আসতে বলেন।

আরও পড়ুন

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নির্ধারিত ইজারার বাইরে কেউ বেশি টাকা নিচ্ছে না। কার্নিভ্যাল ক্রুজ ও ওয়েভের লোকজন নিলে নিতে পারেন। তবে কার্নিভ্যালের কাউন্টারের দায়িত্বরত এনামুল কবীর সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এনামুল কবীর বলেন, ‘আমাদের ভাড়া ১৪ হাজার ২০০ টাকা। ঘাটে কিছু প্রভাবশালী লোক আছে, তাঁরা জোর করে কাঁচামালের গাড়ি ওঠান। তাঁরা বাড়তি টাকা নিতে পারেন, আমরা বেশি নিচ্ছি না। এ ছাড়া ঘাটে অনেক দালাল আছেন, তাঁরাও নিতে পারেন। দালালদের মধ্যে আমার কোনো লোক নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে কাঁচামালের গাড়ি আসে ৫০-৬০টি। দিনে দুবারে ৩০টি নিতে পারেন। যিনি পরে আসেন, তাঁদের পরদিন যেতে বলেন। ৬-৭ দিন অপেক্ষার কথা ঠিক নয়।

দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কেটে রাখা হয়েছে তরমুজ
ফাইল ছবি

ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক পারভেজ খান বলেন, ঘাটে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তিনিও শুনেছেন। ইজারাদারকে নিয়ন্ত্রণ করে বিআইডব্লিউটিএ। এ ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবে। তিনি বলেন, বর্তমানে পাঁচটি ফেরি চলছে। এখন তরমুজের গাড়ির ভিড় বেশি। এ জন্য আরও একটি ফেরি চাহিদা দেওয়া হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর ভোলা নদীবন্দরের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘাটে মালবাহী একটি ট্রাককে ৭০ টাকা ইজারা দিতে হবে। এর বেশি কেউ নিতে পারবেন না। কেউ নিলে তদন্ত সাপেক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

আরও পড়ুন

লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌপথ ব্যবহার করে নিয়মিত ট্রাকে কাঁচামাল পরিবহন করেন বদরুদ্দিন। তিনি বলেন, ইলিশা ফেরিঘাটে এলেই কাঁচামালের গাড়ি থেকে ইজারাদারের লোকজন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা চাঁদা নেন। অথচ ঘাটের ইজারা ৬০-৭০ টাকা। এ নিয়ে প্রতিদিন ট্রাকচালকদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।