কৃষক ইমামের ঘর যেন কবুতরের রাজ্য
মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনির একটি দোচালা ঘর। সেই ঘরে বসবাস সাত সদস্যের পরিবারের। ঘরের চালার নিচে বসানো হয়েছে দেড় শতাধিক মাটির হাঁড়ি। সেখান থেকে আওয়াজ আসছে বাকবাকুম, বাকবাকুম। এক-দুটি নয়, অন্তত তিন শতাধিক কবুতর ডাকছে একই সুরে। কবুতরের দলের এমন শোরগোল শুনলে মনে হবে, এটি কোনো মানুষের বসতঘর নয়। এ যেন এক কবুতরের রাজ্য। কবুতরদের এ রাজ্য গড়ে তুলেছেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়নের পহরচাঁদা গ্রামের কৃষক ইমাম হোসেন (৪০)।
লোহাগাড়া উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে পুটিবিলা এম চর হাটবাজার। সেখান থেকে সাত কিলোমিটার পূর্বে পুটিবিলা হাসনাপাড়া সেতু। সেতুর আগে হাতের বাঁয়ে উত্তর দিকে পহরচাঁদা আশ্রয়ণ পাড়া কাঁচা সড়কটি ধরে এক কিলোমিটার গেলেই হানিফার পাড়া এলাকায় সড়ক লাগোয়া ইমাম হোসেনের বসতঘরটি।
গত শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে ইমাম হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে গম আর ধান ছিটাচ্ছেন ইমাম হোসেন। ‘কইত, কইত, কইত’ শব্দে কবুতরগুলোকে ডাকছেন। তাঁর ডাক শুনে ঘরের ছালার নিচে থাকা মাটির পাতিল থেকে ছুটে এল একঝাঁক কবুতর। কবুতরগুলো উঠান থেকে ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে ধান আর গম খাচ্ছে। উঠানের এক কোণে রাখা আছে পানির ফোয়ারা। খাবার শেষে সেখানে পানি খায় কবুতরগুলো।
প্রথম আলোকে ইমাম হোসেন বলেন, মাটির হাঁড়িতে কবুতর পালনে ব্যয় কম, পরিচর্যা করাও সহজ। ২০০৮ সালে স্থানীয় হাটবাজার থেকে শখের বশে পালনের জন্য তিন জোড়া দেশি কবুতর কেনেন তিনি। ওই তিন জোড়া কবুতরের বাচ্চা থেকে এক জোড়া, দুই জোড়া করে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তাঁর রয়েছে ৩০০টি কবুতর।
ইমাম হোসেন বলেন, প্রতি মাসে গড়ে ১৩০ জোড়া কবুতরের বাচ্চা বিক্রি করেন। প্রতি জোড়া বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দামে। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে ২০টি ময়ূরপঙ্খি (পেছনে ময়ূরের মতো পালক আছে বলেই এদের এই নাম) কবুতর। এ জাতের প্রতি জোড়া কবুতর বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা দামে। ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজন তাঁর বাড়িতে এসে কবুতর কিনে নিয়ে যান। মাঝেমধ্যে তিনি বাজারে গিয়েও বিক্রি করেন।
কবুতর বিক্রি করে মাসে ৩৫–৪০ হাজার টাকা পান বলে জানান ইমাম হোসেন। তিনি বলেন, কবুতরকে তিন বেলা গম, ভুট্টা অথবা ধান ইত্যাদি খেতে দিতে হয়। প্রতি মাসে আয় থেকে খাবার ও ওষুধ বাবদ খরচ করতে হয় ৫–৬ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিলেও ৩০–৩৫ হাজার টাকা থাকে তাঁর।
২০১১ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ইমাম হোসেনের কোমরে সমস্যা দেখা দেয়। তিনি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারেন না। চলাফেরা করার ক্ষমতাও অনেকটা হারিয়ে ফেলেন। ইমাম হোসেন বলেন, ‘শখের বশে কবুতর পালন শুরু করেছিলাম। দুঃসময়ে তা জীবিকার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে ৭ সদস্যের পরিবারের খরচ মেটাতে ভিক্ষার থালা নিয়ে ঘুরতে হতো।’
কবুতর বিক্রির আয়ে সংসারের খরচ এবং সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে ইমাম হোসেন গড়ে তুলেছেন ছোট পরিসরে গরুর খামার, মৎস্য খামার, রাম্বুটান ও লটকন ফলের বাগান। এসব কৃষি প্রকল্প পরিচর্যায় পরিবারের সদস্যরা তাঁকে সাহায্য করেন। ধীরে ধীরে তাঁর আয়ের পরিমাণ বাড়ছে। আগামী বছরের শুরুতে একটি হাঁসের খামার গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
ইমাম হোসেনদের এলাকায় পহরচাঁন্দা কৃষক উন্নয়ন সংঘ নামের কৃষকদের একটি সংগঠন আছে। ইমাম হোসেন ওই সংগঠনের সদস্য। সংগঠনটির সভাপতি খালেদ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ইমাম হোসেনের দেখাদেখি এ অঞ্চলে অনেকে কবুতর পালন শুরু করেছেন। তরুণ উদ্যোক্তারা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নেন। এলাকার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হলে ও সরকারি প্রণোদনা পেলে উদ্যোক্তারা আরও এগিয়ে যাবেন।
লোহাগাড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সেতু ভূষণ দাশ প্রথম আলোকে বলেন, শীতল আবহাওয়া ও শস্যখেত আছে, এমন আবহাওয়া কবুতর পালনের জন্য উপযোগী। বন ও পাহাড়বেষ্টিত এলাকা হওয়ায় লোহাগাড়ার আবহাওয়া শীতল। এ ছাড়া এ অঞ্চলে প্রচুর শস্যখেত রয়েছে। তাই এ অঞ্চল কবুতর পালনের জন্য উপযুক্ত। এ ছাড়া এ অঞ্চলে কবুতরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের টিকা, ওষুধ ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন বলেও জানান প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।