বগুড়ার শাজাহানপুর
কারাগার থেকেই ‘হত্যার ছক’
সাগর হোসেন তালুকদার বর্তমানে কারাগারে। তবে তাঁর গড়ে তোলা ‘সাগর বাহিনী’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাবরুল বাজারে গত চার বছরে চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সব কটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে দিনের বেলায়, প্রকাশ্যে। এসব কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে যাঁর নাম এসেছে, তিনি হলেন সাগর হোসেন তালুকদার (৩৩)। হত্যাসহ ডজনখানেক মামলার আসামি তিনি।
সাগর বর্তমানে কারাগারে। তবে তাঁর গড়ে তোলা ‘সাগর বাহিনী’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর সাবরুল বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বগুড়া শহরে যাওয়ার পথে মাথাইলচাপড় এলাকায় কলেজশিক্ষক ও আওয়ামী লীগের নেতা শাহজালাল তালুকদার ওরফে পারভেজকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ উঠেছে সাগরের বিরুদ্ধে।
সাগর তালুকদার শাজাহানপুরের সাবরুল বাজার এলাকার গোলাম মোস্তফা তালুকদারের ছেলে। পুলিশের নথিতে গোলাম মোস্তফা কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। মাদকসহ একাধিকবার ধরাও পড়েছেন পুলিশের হাতে। বাবাকে অনুসরণ করে ছেলে সাগর অল্প বয়সেই অপরাধজগতে প্রবেশ করেন। গড়ে তোলেন সাগর বাহিনী। জড়িয়েছেন খুন, হত্যা, ছিনতাই, মাদক, অস্ত্রবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। সাগরের বাবা গোলাম মোস্তফাও মাদকের একটি মামলায় এখন কারাগারে রয়েছেন।
■ সাবরুল বাজারে গত চার বছরে প্রকাশ্যে চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
■ এসব খুনের নেপথ্যে সাগর হোসেন তালুকদারের নাম এসেছে।
২ সেপ্টেম্বর সকালে সাবরুল বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বগুড়া শহরে যাওয়ার পথে মাথাইলচাপড় এলাকায় কলেজশিক্ষক ও আওয়ামী লীগের নেতা শাহজালাল তালুকদার ওরফে পারভেজকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সামছুন নাহার বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সাগরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সাবরুল বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবরুল বাজার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করেন সাগর। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ এক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন তিনি। নিজেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী পরিচয় দেন।
নিহত শাহজালালের স্বজনদের অভিযোগ, সাগরের বিরুদ্ধে বিচারাধীন একটি হত্যা মামলায় ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার সাক্ষী হওয়ায় পুরো পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন সাগর। এ কারণে নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করে কারাগার থেকে হত্যার ছক আঁকেন সাগর। মাস দেড়েক আগে নুরুজ্জামানকেও ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তখন শাহজালালকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, কারাগার থেকে কলকাঠি নেড়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে শাহজালালকে হত্যা করা হয়েছে।
সাবরুল বাজারে সাগরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম মামা-ভাগনে এন্টারপ্রাইজ। এক দশক ধরে এই ‘আখড়ায়’ বসে নানা অপকর্মে জড়িয়েছেন তিনি। তাঁর ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি এলাকাবাসী। বাজারের ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, বাড়ি নির্মাণ থেকে ব্যবসা—সবকিছুতেই চাঁদা দিতে হতো সাগরকে। মাদকের কারবারও করেছেন। তাঁর ২৫-৩০ জনের একটি বাহিনী আছে। এই বাহিনী নিয়ে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে চলাফেরা করতেন। কেউ বাড়ি কিনলে বা জায়গাজমি কিনলেও সাগরকে চাঁদা দিতে হতো। সাবরুল ছাড়াও আশপাশে ৩০ গ্রামে ছিল তাঁর দাপট। সড়কে মাছের গাড়ি, যানবাহন থেকে শুরু করে জমি চাষের পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর থেকেও চাঁদাবাজি হতো।
২০২১ সালের ৩০মে সাবরুল বাজারে মাছের আড়তে চাঁদাবাজির জেরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শিহাব উদ্দিন খুন হন। শিহাব উদ্দিন শাজাহানপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাবরুল বাজারের বাসিন্দা ছিলেন।
ওই হত্যাকাণ্ডের মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, শিহাব উদ্দিন মৎস্য ব্যবসায়ী এবং সাবরুল বাজারে নিজস্ব জায়গায় মৎস্য আড়ত আছে। ওই আড়ত থেকে টোল আদায় ও মৎস্য আড়তের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শিহাবের সঙ্গে সন্ত্রাসী সাগর তালুকদারের বিরোধ চলে আসছিল। সেই বিরোধের জেরে শিহাবকে হত্যার পরিকল্পনা করেন সাগর। সাগর ও তাঁর সহযোগীরা শিহাবকে কুপিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় স্ত্রী রুমি খাতুন শাজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলার বাদী রুমি খাতুন বলেন, মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। সাগরের ভয়ে কেউ সাক্ষী দিতে সাহস পাচ্ছেন না।
ওই হত্যাকাণ্ডের সময় সাবরুল বাজার কমিটির সভাপতির পদে ছিলেন নুরুজ্জামান তালুকদার। পুলিশ তাঁকে সাক্ষী করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এ বছরের ২৩ জুলাই সাগর তাঁকে অপহরণ করে ছুরিকাহত করেন এবং পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন। ওই ঘটনার দেড় মাসের মাথায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নুরুজ্জামানের ভাই শাহজালাল পারভেজ।
এর আগে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আবু বকর সিদ্দিক (২৮) নামের এক প্রবাসীকে। শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়নের মাথাইলচাপড় পশ্চিম পাড়ায় দুপুরের দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আবু বকর সিদ্দিক উপজেলার মাথাইলচাপর পূর্ব পাড়ার ইউসুব আলীর ছেলে। তিনি ছয় মাসের ছুটিতে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরেছিলেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে পুলিশ তদন্তে নিশ্চিত হয়।
শাহজালালের সঙ্গে ব্যবসা করতেন তাঁর মামা আবদুল আজিজ। আবদুল আজিজ বলেন, চার বছরে সাবরুল বাজার এলাকায় দিনের আলোয় চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। সব হত্যার নেপথ্যে সাগর তালুকদারের হাত আছে। তাঁর কোনো বিচার হয় না, পুলিশও ব্যবস্থা নেয় না।
শাজাহানপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, সাগরের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা ছাড়াও চাঁদাবাজি, অস্ত্র আইনে ১২টি মামলা আছে। সম্প্রতি একটি মামলায় আত্মসমর্পণ করে তিনি কারাগারে আছেন। কারাগারে থেকেই কলেজশিক্ষক শাহজালালকে হত্যার ছক এঁকেছেন বলে অভিযোগ এসেছে। তদন্তে সাগরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাঁকে এ মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হবে।