রংপুর শহরের এরশাদনগর এলাকার বাসিন্দা সেকেন্দার আলী। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। স্ত্রী নেই। চার ছেলে ব্যবসা করলেও কেউই তাঁর খোঁজ নেন না। আট মাস হলো তাঁর আশ্রয় হয়েছে রংপুর মহানগরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বকশা বৃদ্ধাশ্রমে। বিষণ্ন মনে বিছানায় শুয়ে ছিলেন।
এই প্রতিবেদককে দেখতেই বিছানা থেকে উঠে বসলেন। দীর্ঘ আলাপের একপর্যায়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ‘হামার তো ঈদ নাই, ঈদ থাকলে কি অ্যাটে জায়গা হইল হয়। তারপরও অ্যাটে সেমাই খামো, গরুর গোশত খামো। রোজার ঈদ গেল, তখনো ছাওয়াগুলা (সন্তান) দেখপার আইসে নাই। এবার কোরবানি ঈদোত আসিল না। নতুন কাপড় নিয়া আসল না।’
শুধু সেকেন্দার আলী নন, সন্তানদের থেকে দূরে থেকে ঈদ উদ্যাপনের একই ধরনের অনুভূতি হামিদা বেগম (৬০), আশরাফুল আলম (৭০), আমেনা বেগম (৬০), রইস উদ্দিন (৭৫), সালেহা বেগম (৬৫), শাকিলা বেগমসহ (৬৫) এই বৃদ্ধাশ্রমের নিবাসী সবার।
বৃদ্ধাশ্রমের চারদিকে সবুজ গাছগাছালি। নিরিবিলি পরিবেশে এই বৃদ্ধাশ্রম। গাড়ির উচ্চ শব্দে হর্ন নেই। তবে আধা পাকা টিনশেডের বাড়িতে নিবাসীদের থাকার ঘরগুলো জরাজীর্ণ। ৩১ শতাংশ জমির ওপর বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে ৩১ জন নারী-পুরুষের আশ্রয় হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন নারী ও ১৬ জন পুরুষ। ঢাকা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় তাঁদের আদিনিবাস হলেও এখন এই বৃদ্ধাশ্রমই তাঁদের ঠিকানা।
আজ রোববার সরেজমিনে ঈদ উদ্যাপনের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় হওয়া ব্যক্তিরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কারও মুখে হাসি নেই। কেবল নির্নিমেষ দৃষ্টি। কোনো কক্ষে দুটি, আবার কোনো কক্ষে তিনটি, চারটি বিছানাও রয়েছে। মাথার ওপর ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। কেউ শুয়ে আছেন, কেউবা বসে। আবার কেউ কেউ হাঁটাচলা করছেন। নতুন মানুষ এলে তাঁদের দিকে ছুটে যান। কিছু একটা বলতে চান।
ষাটোর্ধ্ব হামিদা বেগমের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের বালাটারি গ্রামে। স্বামী নেই। চোখে কম দেখেন। কোনোরকমে হাঁটাচলা করতে পারেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁদের বিয়ে হয়েছে। ছেলে দুই মাসে দুবার এসে দেখে গেছেন। মেয়ে কোনো খোঁজই নেন না। আট মাস আগে হামিদা বেগমের আশ্রয় হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। কোরবানি ঈদের স্মৃতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একসময় কত আনন্দ করছি। বাড়ির সামনোত বসিয়া গোশত কাটছি। এ্যালা সেই আনন্দ নাই। ছাওয়া দুইটাও খোঁজ নেয় না। সেই কথা মনে হইলে কষ্ট তো লাগে। এবার ঈদোত অ্যাটে পোলাও খামো, গোশত খামো।’
রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়া এলাকার বাসিন্দা সালেহা বেগম। স্বামী নেই। দুই ছেলে থাকলেও তাঁরা কেউই খোঁজখবর নেন না। এখানে এক বছর থেকে আছেন। ঈদের অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অ্যাটে হামার জীবন, অ্যাটে হামার ঈদ। ছাওয়া দুইটাও দেখতে আইসে না। তার ওপরও ঈদোত সেমাই খামো, পোলাও খামো, গোশত খামো।’
রইচ উদ্দিনের বয়স ৭৫ বছর পেরিয়ে গেছে। বাড়ি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার স্টেশন রোড এলাকায়। স্ত্রী নেই। দুই ছেলে ও চার মেয়ে। সবারই বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে ঢাকায় চাকরি করলেও তাঁরা কেউই দেখতে আসেন না বলে জানালেন। ১০ মাস হলো তাঁর ঠাঁই হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। রইচ উদ্দিন বলেন, ‘ঈদোত ছাওয়ারা আনন্দ করবে। ছাওয়ারা পাশে না থাকলেও তারপরও এখানে ভালো আছি। এখানে আমার দেখাশুনা ও সেবাযত্ন করার মানুষ আছে।’
দুপুরে দেখা যায়, বৃদ্ধাশ্রমে ভাত খাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সেবাযত্নে প্রতিষ্ঠানের তিনজন নিবেদিত হয়ে কাজ করছেন। কেউ কেউ ভাত তুলে খাওয়াচ্ছেন। নিবাসীদের দেখভালের জন্য দায়িত্বে থাকা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খাওয়া-গোসল থেকে সব কাজ করে দিই। তাঁদের কষ্টের কথাগুলো শুনলে আমারও খারাপ লাগে। এই বয়স্ক মানুষদের সেবাযত্নের মাধ্যমে আনন্দ খুঁজে পাই।’
বকসা বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা রেজাউল করিম। তিনি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কর্মরত (রিজার্ভ অফিসার)। আড়াই বছর আগে রংপুর মহানগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ময়নাকুঠি বকসা এলাকায় তাঁর পৈতৃক ভিটায় গড়ে তুলেছেন এই ‘বকসা বৃদ্ধাশ্রম’। তাঁর নিজের বেতনের টাকা ছাড়াও পরিবারের সহযোগিতা রয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনায়। স্থানীয়দের অনেকেই মা–বাবার মৃত্যুবার্ষিকী, ছেলে-মেয়ের জন্মদিনসহ বিভিন্ন উপলক্ষ ঘিরে এই বৃদ্ধাশ্রমে খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন।
বৃদ্ধাশ্রমে আসা মা-বাবাদের সেবাযত্নে রেজাউল করিমের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা তাঁর স্ত্রী নাহিদ নুসরাত। আর তাঁদের এই উদ্যোগে এখন ছায়াসঙ্গী হয়েছেন মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস। এসআই রেজাউল করিম বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা এই মা-বাবাদের নিয়মিত তিন বেলা খাবার দেওয়া ছাড়াও অসুস্থদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। যদি কেউ অসুস্থ হন, তাঁদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স সুবিধাও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমটির অবকাঠামো উন্নয়ন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অর্থাভাবে সেটি করতে পারছি না। এখন ঝড়বৃষ্টি হলে একটু সমস্যা হচ্ছে। যদি অবকাঠামোগত দিক থেকে উন্নত করা যেত, তাহলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে এসব মা-বাবা আরও ভালো থাকতে পারবেন। এখন তাঁদের সপ্তাহে এক দিন একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। আমি চাই প্রত্যেক মা-বাবা ভালো থাকুক। সবার সহযোগিতা পেলে হয়তো বৃদ্ধাশ্রমটিতে আরও উন্নত পরিবেশ করা সম্ভব হবে।’
স্থানীয় কাউন্সিলর আনারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এই বৃদ্ধাশ্রম প্রশংসার দাবি রাখে। আরও ভালো ও বড় পরিসরে এর কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য এর সহযোগিতায় আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত।’
এসআই রেজাউল করিমের এ উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত কমিশনার সায়ফুজ্জামান ফারকী বলেন, ‘এটি একটি ভালো উদ্যোগ। মানবতার সেবায় এ বৃদ্ধাশ্রম এগিয়ে চলুক, এমন প্রত্যাশা করি।’