রাতুল হাঁটলেন ভিন্ন পথে

নিজের খামারে গাভির পরিচর্যায় ব্যস্ত তারাগঞ্জের রাতুল আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

মা–বাবা দুজনেই শিক্ষক। বড় ভাইও চাকরিজীবী। মাস্টার্স পাস সহপাঠীরাও ছুটছেন চাকরির জন্য। রাতুল আহমেদেরও সে অনুযায়ী চাকরির পথে হাঁটার কথা; কিন্তু তিনি হাঁটলেন ভিন্ন পথে। ছোটবেলার স্বপ্নপূরণে গড়ে তোলেন খামার। এখন তাঁর মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকা। তাঁর দেখানো পথ এখন অনুসরণ করছেন এলাকার অন্য যুবকেরা।

রাতুল আহমেদের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার উত্তর ঘনিরামপুর গ্রামে। সবুজে ঘেরা গ্রামের রাস্তাঘাটে সারি সারি নানা প্রজাতির গাছ। মাঠজুড়ে চরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য গাভি আর বাছুর। গ্রামের নারী–পুরুষেরাও ব্যস্ত খামার পরিষ্কার, গাভির যত্ন ও দুধ সংগ্রহে।

রাতুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গাভিকে গোসল করাতে ব্যস্ত রাতুল। কাজ শেষে খামার থেকে বেরিয়ে এলেন। শোনালেন উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। সেই ২০১৮ সাল। তখন তিনি ছিলেন ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সে সময় টিউশনির জমানো ১৫ হাজার টাকায় গ্রামের এক দিনমজুরকে গাভি কিনে বর্গা দেন। এক বছরে সেখানে লাভ আসে ২০ হাজার টাকা। এই লাভ চোখ খুলে দেয় রাতুলের। সিদ্ধান্ত নেন গাভির খামার করবেন। সে মোতাবেক ২০১৯ সালে গ্রামে এসে যুব উন্নয়ন ও প্রাণিসম্পদ থেকে গাভি পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। ওই বছরেই করোনা মহামারির সময় নিজের জমানো এক লাখ ও মায়ের কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে ফ্রিজিয়ান জাতের একটি গাভি কিনে বাড়িতে গড়ে তোলেন থ্রি–স্টার ডেইরি ফার্ম। এরপর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওই বছরে আরও দুটি গাভি কেনেন। গাভি দুধ দেয়, বাছুর দেয়। আয় বাড়ে, বাড়ে খামারের পরিধি। এখন রাতুলের খামারে ১৮টি গাভি রয়েছে। প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ লিটার দুধ দেয়। এ দুধ নিজেই প্যাকেটজাত করে ৭০ টাকা লিটার দরে প্রায় ৯ হাজার টাকা বিক্রি করেন।

গাভির খাবার, অবকাঠামো ব্যয়, শ্রমিক ব্যয়ের পর রাতুলের দৈনিক দুই হাজার টাকা আয় হয়। এবার কোরবানির ঈদেও ১২ লাখ টাকার গরু খামার থেকে বিক্রি করেছেন। খামার দেখাশোনার জন্য দুজন কর্মচারী রয়েছেন।

রাতুল বলেন, ছয় বছরের খামার থেকে আয়ের টাকায় আবাদি জমি কিনেছেন। খামারের অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন। গড়েছেন মাছের খামার, কিনেছেন মোটরবাইক। শাকসবজিসহ করছেন নানা ফসলের চাষাবাদ। খামার থেকে এখন তাঁর মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘দেশে চাকরির বাজারে খুবই প্রতিযোগিতা। তাই নিজে কিছু করার চিন্তা আমার ছোটবেলা থেকেই। টিউশনির টাকায় যখন একটি গাভি কিনে বর্গা দিই। তা বিক্রি থেকে যখন মোটা টাকা লাভ আসে। তখনই খামার করার সিদ্ধান্ত নিই। এখনো আমার অনেক বন্ধু চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, পরিবার থেকে টাকা নিয়ে চলছে। সেখানে আলহাদুলিল্লাহ আমার মাসে আয় ৬০ হাজার টাকা। মা–বাবা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমার দুধেভাতে সুখের দিন যাচ্ছে। আমার স্বপ্ন ১০০ গাভির একটি খামার গড়ার।’

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, রাতুল গাভি পালন করে শুধু নিজের ভাগ্য বদল করেননি, এলাকার অন্য যুবকদেরও পরামর্শ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলছেন। বেকার না ঘুরে অনেকে গাভির খামার করে সফল হয়েছেন।

উত্তর ঘনিরামপুর গ্রামের রবিউল ইসলামও বেকার ছিলেন। রাতুলের পরামর্শে তিনিও গাভির খামার করেছেন। রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বেকার থাকার কী যে যন্ত্রণা যে বেকার আছে সে–ই জানে। রাতুলের পরামর্শে গাভি পালন করে বেশ ভালো আছি। দুধ বেচে সংসার চলছে। প্রতিবছর গরু বিক্রি করে মোটা টাকা আয়ও হচ্ছে।’

রাতুলের অনুপ্রেরণায় গাভির খামার শুরু করেন ওই গ্রামের মাহামুদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘রাতুলের সাফল্য দেখে তিন বছর আগে দুটি গাভি দিয়ে খামার শুরু করি। এখন আমার খামারে ছয়টি গাভি আছে। খামারে দুধ বিক্রি করে খরচ বাদে মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।’

উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকবার রাতুলের খামারে গিয়েছি। তিনি একজন মডেল খামারি। তাঁর খামার অনেক পরিচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। যেকোনো সমস্যায় আমরা তাঁর পাশে আছি। তারাগঞ্জের বেকার যুবকদের জন্য দৃষ্টান্ত রাতুল। তাঁর দেখানো পথে অনেকেই খামার করে এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন।’